মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে এখন ‘সংবিধানসম্মত’ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে লড়ছেন। বিষয়টি বেশ অসুন্দর দেখতে। মনে হচ্ছে দুই পক্ষ যুক্তি করে মাঠে নামছে। কিন্তু খুব কাছ থেকে যা দেখছি তাতে এ সন্দেহ মনের মধ্যে রাখা সমীচীন নয়। এর আগেও শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলন করেছ্নে। সেটি তাদের মতো করে তারা পরিচালনা করেছেন। তখন এ আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন ভিপি নূর (নুরুল হক)। তখন তার কথাবার্তা ছিল সদ্যমুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা যোদ্ধার মতো।
কিন্তু ধীরে ধীরে তার সে ঔজ্জ্বল্য যেন ম্রিয়মাণ হতে থাকল এবং একসময় ময়ূরপুচ্ছের আড়াল থেকে বিশাল এক কাক বেরিয়ে এলো। এবার যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের বক্তব্যও হৃদয়গ্রাহী। তারা বলছেন, সংবিধান তার দেশের জনগণের মধ্যে বৈষম্যের সুযোগ রাখেনি।
খুবই সত্যি কথা। তাদের ৬ জুলাইয়ের বক্তৃতাটি আমাকে খুবই আপ্লুত করেছে। সমন্বয়কদের একজন বলেছেন, শেখ হাসিনাকে নিয়ে আমাদের ভয় হয়। কারণ বঙ্গবন্ধুর পাশে মোশতাকরা ছিল। এখনও প্রধানমন্ত্রীর পাশের মোশতাকরা তাকে সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না। এ কথাাটি বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা সবাই উপলব্ধি করেন এবং সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকেন যে, যারা অনেক আপন বলে চারদিকে ঘুরঘুর করে তারা কোনো দুঃসময় সৃষ্টি করবে না তো? তারা মূল কারিগরে রূপান্তরিত হবে না তো? এ প্রসঙ্গে আবারও নূরের কথা বলতে হচ্ছে। নূরই বোধহয় কোটা আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনার উদ্দেশে ‘মানবতার মাতা’শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিলেন। যত দূর মনে পড়ে ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর নূর গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন। কিন্তু পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত তার বক্তৃতাগুলো অনেক ক্ষেত্রে হেফাজতিদেরও ছাড়িয়ে যায়। শঙ্কার বিষয়টি এখানেই।
আসা যাক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি প্রসঙ্গে। প্রথমে শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে প্রতিবন্ধী ছাড়া সব কোটা বাতিল করার। কিন্তু পরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কোটা বাতিলের বিষয়টি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সাংবাদিক-কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের একটি ছোট্ট লেখায় দেখলাম শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা কোটাব্যবস্থা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার পক্ষে। অবশ্যই এটি একটি যৌক্তিক দাবি। এখানে কোনো একগুঁয়েমি নেই। তবে এ যৌক্তিকতা কার কাছে কেমন তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অন্যদিকে মহামান্য উচ্চ আদালত রাষ্ট্রপক্ষকে বলেছেন, আন্দোলনের কারণে আদালতের আদেশ পাল্টাতে চান কি না? এ বিষয়ে লিভ টু আপিল করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটিও, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী চাইলেও ঘোষণা দিতে পারবেন না। কারণ তার ওপর আদালত রয়েছেন। অতএব বিষয়টি কিছুটা জটিল হয়ে পড়েছে।
এমনও হতে পারে, লিভ টু আপিলের নিষ্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। আন্দোলনের সমর্থনে যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখছেন, তাদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা বা সন্তানদের অসম্মান করে কথা বলছেন। মনে রাখতে হবে, ওই সূর্যসন্তানরা না হলে এ লেখালেখিও করতে পারতেন না। সারা জীবনই পাকিস্তানের দালালি করতে হতো। কয়েক দিন আগে বঙ্গবন্ধুর চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসে। ছবিটি সম্পাদিত এবং সেখানে তিনি একটা প্রাইভেট গাড়ির পেছনে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। এর নিচে সহস্রাধিক মন্তব্য দেখে স্পষ্টতই অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মন্তব্যটি বারবার মনে পড়ল- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। কোটা আন্দোলনের পক্ষে এদের অনেকেই মন্তব্য লিখতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আক্রমণ করছেন। এ বিষয়টি কোটা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মাথায় রাখার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। শিক্ষার্থীরা কি সত্যিই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল চান? যদি তা চানই তাহলে কেন চান?
বাংলাদেশে এখনও চাকরির ক্ষেত্র ছাড়াও অন্য বহু জায়গায় কোটা রয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষক-কর্মচারীদের একটা কোটা আছে। দেখা গেছে, মা-বাবার কোটায় ভর্তি হয়ে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন অনেকে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এবং বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় নামে সেনাবাহিনী পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। এমনকি ভর্তির ফলাফলের সময়ে ওখানে অপেক্ষমাণ তালিকাও প্রকাশ করা হয় না। যখন সিট খালি থাকে তখন খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কতটা আসন খালি জানবার উপায় নেই। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিযুদ্ধফেরত অনেকেই আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। কিন্তু খেটে খাওয়া কৃষক, দিনমজুর, ঘাম ঝরানো শ্রমিক এমনকি তখন অনেক ছাত্রের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এই শেখ হাসিনাই তাদের খোঁজ করেছেন এবং তাদের বেঁচে থাকার একটা আপাত ব্যবস্থা করেছেন। এর মধ্যে খুঁজলে দেখা যাবে যে, একজন মুক্তিযোদ্ধার একজন ছেলেকে বা নাতি-নাতনিকে তিনি একজন অফিস সহায়ক বা প্রহরী বা মালী বা পাচক পদে চাকরির জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠেছেন। কারণ সুযোগের অভাবে তাদের তেমন পড়াশোনা করানো যায়নি। এই শ্রেণির কোটাব্যবস্থা উঠে গেলে ওই মানুষটির আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। এ ধরনের বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশে রয়েছেন। তাই কোটা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ যদি সত্যিই বাংলাদেশকে লালন করেন তাহলে এ বিষয়টি তাদের বিবেচনায় থাকা উচিত। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে সম্মানজনক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগেও পোষ্য কোঠা রয়েছে। অন্যান্য গ্রেডে কোটাব্যবস্থার সংস্কার হতে পারে। যদি শতকরা ৫৬ ভাগ কোটায় চলে যায় তাহলে তো মেধাবীর সংখ্যা হয়ে যায় ৪৪ ভাগ। এটি কাম্য নয়।
এবার প্রত্যয় পেনশন স্কিম নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। কোটা ও শিক্ষক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় অচল। যখন সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো তখন আমাদের মনে হয়েছে যে রাষ্ট্রীয় বেতন স্কেলের আওতায় যারা কাজ করেন না বা এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে পেনশন গ্রাচুইটি কোনো কিছুই নেই অথবা মাসিক বা বার্ষিক একটা আয় আছে কিন্তু ভবিষ্যতে বা বৃদ্ধ বয়সে চলার মতো কোনো সঞ্চয় নেই তাদেরই এ পেনশন স্কিমের আওতায় এনে ভবিষ্যৎ জীবন কিছুটা স্বস্তিদায়ক বা নির্বিঘ্ন করা হবে।
এমনকি গ্রামের কৃষকও এর আওতায় চলে আসতে পারেন, যদি তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ স্কিমে জমা রাখেন। অনেক বছর পর তার সুদ এবং সরকারি সহায়তা মিলে বৃদ্ধ বয়সে চলার মতো একটা গতি হবে। এ ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পেলাম দেশের তারকা খেলোয়াড়, শিল্পী, সাহিত্যিক অনেকেই স্কিমে যুক্ত হচ্ছেন। পেনশন কর্তৃপক্ষ সেটি যথাযথভাবে প্রচারও করেছে।
তখন বলা হয়েছিল, সরকারি কর্মচারী ছাড়া অন্যরা এ পেনশন স্কিমের আওতাভুক্ত। কিন্তু ধীরে ধীরে মূল নীতিমালাটি বিস্তারিত সামনে আসার পরে দেখা গেল স্বায়ত্তশাসিত, আধাস্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানও এ পেনশন স্কিমের আওতাভুক্ত! তখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিগুলো ফেডারেশনের মাধ্যমে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই হয়নি। একটু পেছন ফিরে তাকাই। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩-এর অ্যাক্টের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন সেখান থেকে জিয়াউর রহমানের সময় বিশ্ববিদ্যালয় তার মর্যাদা হারাতে থাকে। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষমতা অনেকাংশে কমিয়ে দেওয়া হয়।
এরশাদের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছে। তখন শিক্ষকরা তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। তখন সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তবে আর্থিক ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব দিয়েছিলেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পৃষ্ঠাগুলা ওল্টালে আমরা দেখতে পাব বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এটি প্রণয়নের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষকরা যুক্ত ছিলেন। এমনকি বাংলাদেশ আন্দোলনের গোড়ার দিকে অর্থাৎ ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে বঙ্গবন্ধু অলিখিতভাবে শিক্ষকদের তার কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন। দীর্ঘকাল শেখ হাসিনাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। কিন্তু ২০১৫ সালের বেতন স্কেলের সময় শিক্ষকরা একবার ধাক্কা খান। তবে তখন তিনিই বিষয়টির নিষ্পত্তি করেন।
অনুমান করি, বেতন স্কেলের ভেতরে শিক্ষকদের এক ধাপ অবনমনের বিষয়টি প্রথমে তার চোখ এড়িয়ে যায়। এবারও তিনি পুরো বিষয়টি দেখেছেন কি না জানিনা। তবে বিশ্বাস করি বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থা ও নতুন সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতির পাথর্ক্য যদি তিনি অনুধাবন করেন তাহলে হয়তো বেশি দিন আন্দোলন করতে হবে না। ১ জুলাই থেকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে আসছেন তাদের মূল বেতন থেকে ভবিষ্য তহবিল এবং পেনশন মিলিয়ে শতকরা ২০ ভাগ কর্তিত হবে। ওই শিক্ষক তো চলতে পারবেন না। তাহলে পড়াবেন কীভাবে? মূল কথা হলো এত দিন তো পেনশনের জন্য কোনো টাকা জমা দেওয়া লাগেনি, এখন প্রতি মাসে ভবিষ্য তহবিলের মতো টাকা জমা দিয়ে তার পেনশন নিতে হবে! তাহলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দুটি ভবিষ্য তহবিল হলো। পেনশন আর থাকল না।
এতদিন একজন শিক্ষক প্রজাতন্ত্রের অন্য কর্মচারীদের মতো সারা জীবন দেশের জন্য সেবা প্রদানের নিমিত্ত অবসর জীবনে ভালোভাবে চলার জন্য যে সুবিধা পেতেন মূলত তা আর রইল না। বরং ৪০ বছর পর্যন্ত ব্যাংকে টাকা রেখে তার মুনাফা দিয়ে শিক্ষকদের চলতে হবে। আমাদের চোখের সামনে অবসরপ্রাপ্ত ৮০ বছর বয়স্ক শিক্ষকরা দিব্যি চলাফেরা করছেন। তাদের মৃত্যু হলে তাদের জীবিত স্ত্রীরা এ পেনশন সুবিধা পাবেন। কিন্তু নতুন নিয়মে ৭৫ বছর বয়সে একজন শিক্ষকের মৃত্যু হলে তার স্ত্রী বা পোষ্য এক দিনও পেনশন পাবেন না। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হয়নি। আশা করি অতীতের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগেই এ অবস্থার নিষ্পত্তি ঘটবে। কারণ শিক্ষকদের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ সুবিদিত।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়