<
শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২৯ ভাদ্র ১৪৩১
শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪, ৪:৩১ PM
বেশ কিছুদিন থেকেই বলা হচ্ছে যে আমাদের অর্থনীতিতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ আছে। কিছু চ্যালেঞ্জ আছে বৈদেশিক, এর সমাধান কিছুটা আমাদের আওতার বাইরে। আমাদের দেশীয় কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলোর সমাধান আমাদের আওতার মধ্যেই। সবগুলো মিলিয়েই নতুন করে মোটামুটি বাজেট দেওয়া হয়েছে। নতুন করে মুদ্রানীতিও ঘোষণা করা হয়েছে। পর পর দুটি সামষ্টিক নীতি ঘোষণা করা হলো। একটা হলো বাজেট—যেটা রাজস্বনীতি। আরেকটা হলো মুদ্রানীতি।

আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভক্ষয়, জ্বালানি সমস্যা, ব্যাংকিং সমস্যা, রেমিট্যান্স সমস্যা এবং আরো অনেক অর্থনৈতিক সমস্যা। সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটটা তেমন কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। যেসব সমস্যার সমাধান করার কথা ছিল সেগুলো করা হয়নি। কয়েকদিন আগে ছয়মাসের জন্য মুদ্রানীতি দেওয়া হলো। মুদ্রানীতিটা গতানুগতিক হয়েছে, বর্তমানে প্রেক্ষিতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। পলিসি রেট, নীতি সুদের হার, রিভার্স রেপু রেট, ফিন্যানশিয়াল রেট- এগুলো প্রায় অপরিবর্তিত।

মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল হাতিয়ার। তারা সুদের হারও তেমন বাড়ায়নি। সুদের হার আগের মতোই রেখেছে। তবে শুধু কতগুলো টার্গেট পরিবর্তন করেছে। বেশি পরিবর্তন করেনি। শুধু প্রাইভেট সেক্টরের উল্লেখযোগ্য একটা টার্গেট হলো ক্রেডিট। ক্রেডিট ৮.৯ করেছে, কমিয়ে নিয়ে এসেছে।  

সার্বিকভাবে মুদ্রানীতিটা মোটামুটি আগের মুদ্রানীতির মতোই। বলা চলে, আগের মুদ্রানীতি নতুন করে আবার শুধু ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা করতে পারে। আমার বক্তব্য, যে মুদ্রানীতিটা ছয় মাসের জন্য করল—জানুয়ারি থেকে জুন—ফলটা কী হলো। সুদের হার বাড়াল, পলিসি রেট বাড়াল, এক্সচেঞ্জ রেটটা ক্রলিং পেগে নিয়ে গেল।

সেটার তো উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। শুধু ক্রলিং পেগ করাতে ডলারের দাম কিছুটা বেড়েছে, রেমিট্যান্স কিছুটা আসছে। সুদের হার বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি তো কমেনি। কমার কোনো লক্ষণ নেই। বর্তমান মুদ্রানীতি যে সফল হবে, আমার মনে হয় না। এখনো তো ব্যবসা-বাণিজ্য, দেশীয় শিল্প, বিদেশি রপ্তানি, রেমিট্যান্স যে খুব বেশি বেড়ে যাচ্ছে তাও নয়। জ্বালানির ব্যাপারে সমস্যার সমাধান হয়নি। 

স্বল্পমেয়াদি কিছুটা দাম বাড়িয়েছে, সেটা সমাধান নয়। মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার কোনো সমাধান নেই। এই প্রেক্ষিতে মুদ্রানীতিটা ইনসিগনিফিকেন্ট। এটা একটা সামষ্টিক নীতি। সামষ্টিক নীতির দুটি দিক, একটা হলো রাজস্বনীতি ও আরেকটি মুদ্রানীতি। সরকারের ট্রেজারি বিল, ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে টাকা দেবে। যেহেতু রাজস্ব আয়ে কম পড়বে, সরকারের বিভিন্ন কাজে- উন্নয়নকাজে হোক- সরকার ব্যয় করতে পারবে। কিন্তু সেটা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর প্রত্যক্ষ কোনো সহায়তা করবে না। দেশকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রোথ বাড়াবে না। কোনো সহায়তা করবে না। বলতে গেলে এছাড়া দুটি সামষ্টিক নীতির কোনো সমন্বয় নেই।

দেখলাম, গ্রোথটা ৬.৭ শতাংশ রেখেছে, মূল্যস্ফীতিটাও যেটা করেছে ৬.৫ শতাংশ। গ্রোথের ব্যাপারে আমি এত চিন্তা করি না, গ্রোথ হয়তো কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। তবু সন্দেহ আছে, বিভিন্ন সেক্টরে যে গ্রোথ হচ্ছে, সেটা পণ্য উৎপাদন, সেবা বা অন্যান্য খাতে উজ্জীবিত হচ্ছে না, সেটা টের পাওয়া গেছে। মন্থর হয়ে আছে। 

মূল্যস্ফীতির কথা না-ই বললাম। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এখনো পুনরাবৃত্তি করছে। এতে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সুযোগ নেই। কারণ পণ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাজার মনিটর করতে হবে। এগুলো না করলে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে না। সামষ্টিক নীতিগুলোর ব্যাপারে আমার মনে হয়—এক. দুটি নীতি খুব বাস্তবতাভিত্তিক নয়। সঠিকভাবে প্রণয়ন করা হয়নি। দুই. কৌশলগুলো যথাযথ হয়নি। তিন. এগুলো বাস্তবায়িত হবে না। বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ যেসব প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাস্তবায়ন করবে, যেসব লোক দিয়ে বাস্তবায়ন করবে—তাদের সক্ষমতা বাড়েনি, তাদের জবাবদিহি বাড়েনি, তাদের স্বচ্ছতাও বাড়েনি। এই হলো সামষ্টিক নীতি এবং সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা।

সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জসমস্যাগুলো জটিলতর হচ্ছে। এখানে নতুন অনেক কিছু চলে আসছে। সরকারের একটা সংস্কারভীতি আছে। সংস্কারভীতিতে এ দেশে এক রকম অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সার্বিকভাবে এ রকম অবস্থা থাকলে তো স্বাভাবিক কাজ হবেই না; অন্যান্য উন্নয়নকাজ ব্যাহত হবে। সংস্কারভীতিটা কেন? ব্যাংকিং সেক্টরের ক্ষেত্রে কতবার বলা হচ্ছে সংস্কার দরকার। করছে না। নানা রকম ছোটখাটো অ্যাকশন নিয়ে ব্যাংকিং অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তারা কোনো সুষ্ঠু ভূমিকা নিতে পারছে না। নিচ্ছেও না।
শিক্ষা খাতের অবস্থা হলো একবার বলা হয় পরীক্ষা থাকবে, আবার বলে থাকবে না। এটা বহুদিন যাবৎ হচ্ছে। শিক্ষা খাতে আমাদের একটা ভঙ্গুর অবস্থা চলে আসছে। এটা প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাই বলি—একবারে সব ক্ষেত্রেই। শিক্ষকদের অবশ্য কিছুটা দায়দায়িত্ব আছে। আসল দায়দায়িত্ব সরকারের—শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলামের ওপর।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা তো আরো মারাত্মক। দিন দিন স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রাইভেট সেক্টরে চলে যাচ্ছে। দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। কয়েক দিন আগে দেখলাম, অনেক সরকারি হাসপাতালে নাকি বিভিন্ন মেশিন নষ্ট। এমনকি ক্যান্সারের ক্যামো থেরাপি মেশিন নষ্ট। এগুলো কি কাজের কথা। এখানে যদি সুষ্ঠুতা, জবাবদিহি এবং সংস্কারগুলো না করে তাহলে তো বিপর্যয় নেমে আসবে। এই যে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে এত টাকা খরচ করেছে কী লাভ হবে।
আইএমএফ বলছে, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করো। আইএমএফ তো অন্য খাতে সংস্কার করতে বলবে না। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করলে অন্য খাতেগুলোতেও সংস্কার করতে হবে। সংস্কারভীতির জন্য এবং বর্তমান অবস্থার জন্য যেটা হয়েছে, আমাদের ইমপ্যাক্টটা যেটা এখন ইনফ্লুয়েন্স করছে—যার ফলে দেশে ছাত্র-ছাত্রীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমত, অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। আগেও ছিল, এখন তো আরো। এই স্থবিরতার কারণে লোকজনের কর্মসংস্থান কমে যাবে। লোকজনের আয়ের উৎস কমে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাবে। এটা তো কোনোক্রমেই কাম্য নয়। দ্বিতীয়ত, বিদেশি বাণিজ্য। এখন কয়েক দিন ইন্টারনেট বন্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কোনো যোগাযোগ করা যায়নি। এলসি খোলা বন্ধ এবং পোর্ট বন্ধ ছিল। পোর্টে যোগাযোগ হচ্ছে না। বিমানবন্দরে অল্প ফ্লাইট যাচ্ছে। বহির্বিশ্বে তো আইটি টেকনোলজির ওপর নির্ভর করে লোকজন। তারপর যাতায়াতব্যবস্থা তো আছেই। সেটাও তো বন্ধ ছিল। এগুলোর কারণে একটা দীর্ঘমেয়াদি ইমপ্যাক্ট পড়ে। পরিস্থিতি এখন শান্ত-স্বাভাবিক বলা যাবে না। সব কিছু আগের মতো ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।
সাপ্লাই চেইনে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করার ব্যাপার আছে। প্রডাক্ট আসবে, সেটা কেউ তৈরি করবে। সেটা বাজারে যাবে, তারপর ভোক্তার কাছে যাবে। এমনকি গার্মেন্টস সেক্টরে তো সাপ্লাই চেইন আছে—ওরা তৈরি করে প্যাকেজিং করে পাঠাবে বিদেশে। সবগুলো তো স্থবির হয়ে আছে।
আইটি সেক্টরে বহু লোক কাজ করে। ই-কমার্স, এমনকি দরিদ্ররাও তো বিকাশ, নগদ, রকেটে লেনদেন করে। অনেকে অনলাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাবেচা করে। বাইরে যোগাযোগ, পণ্য তৈরি করে মোবাইলে মেসেজ পাঠানো, পণ্য পাঠানোর লোকেশনও মোবাইলে জানার ব্যাপার, মৎস্যজীবীরাও ইন্টারনেটনির্ভর ব্যবসা করে—বর্তমান পরিস্থিতি তো সবার ওপর প্রভাব ফেলছে। সবাই অস্থিরতার মধ্যে ছিল।
আরেকটি বড় ব্যাপার হলো, বাইরের সঙ্গে সংযোগ ছিল না। ফলে যে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বা বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার যে স্কোপ, সেখানে তো আস্থা কমে যায়। আর যেসব বিদেশিদের এখানে বিনিয়োগ আছে, তারা তো টেনশনে আছে। শঙ্কায় আছে। তারা কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। ব্যবসা-বাণিজ্য ভবিষ্যতে কী হবে। আমাদের যে বড় উদ্দেশ্য, বিনিয়োগ বিনির্মাণ করব, বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেব, সে উদ্দেশ্য তো সফল করা কঠিন হবে।

সব শেষে হলো, এখন যে অবস্থার মধ্যে আছে, বেরিয়ে আসার কী উপায়? প্রথমত, ছাত্রদের অবিশ্বাস, সাধারণ মানুষ এবং অভিভাবকদের আস্থাহীনতা, ব্যবসায়ীদের আস্থাহীনতা, বিদেশিদের কিছুটা আস্থাহীনতা—এই আস্থার জায়গাটা সরকারকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য খুব দ্রুত যত রকম দুর্নীতি, যত রকম করাপশন, যত রকম মানি লন্ডারিং—সব বন্ধ করতে হবে। কী করে একজন অফিসের পিয়ন ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে চলে যায়? এটা কি একদিনে হয়েছে? এর আগে তো আরো কয়েকজন করেছে। সাবেক আইজিপি করেছে। এগুলো তো প্রকৃষ্ট উদাহরণ। লোকজন এগুলো শুনলে অত্যন্ত হতাশায় ভুগে। এই যে একটা সুখী-সমৃদ্ধিশীল বাংলাদেশের ব্যাপার, সেটা তো আর থাকে না। অনেক তরুণ তো বাইরে চলে যাচ্ছে।
আমাদের সমস্যাগুলো আরো জটিল হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে এটাকে উদ্ধার করা, সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, মানুষের সামাজিক জীবনে নানা রকম সমস্যা এগুলো থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কঠিন হবে। এটা এখনই আমাদের নীতিনির্ধারক, প্রশাসক এবং আমি বলি সর্বোপরি সমস্ত রাজনৈতিক দলকেও এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। সরকারের উচিত, সব রাজনৈতিক লোকদের সহযোগিতা নেওয়া। অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে প্রতিপক্ষ না ভেবে, তাদের ওপর দোষারোপ না করে সবার সহযোগিতা নেওয়া প্রয়োজন। সবার সহযোগিতা না নিলে সমস্যা থেকেই যাবে। সমস্যা থেকে বের হওয়া যাবে না।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







সোস্যাল নেটওয়ার্ক

  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক আউয়াল সেন্টার (লেভেল ১২), ৩৪ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত