মানবতার ধর্ম ইসলাম নারী জাতিকে এক জীর্ণ দশা থেকে উদ্ধার করে যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তারই নিদর্শন স্বরূপ বিবাহে দেনমোহর প্রচলন। যা ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে পুরুষ কর্তৃক নারীকে প্রদেয়। দেনমোহর ব্যতীত কোন মুসলিম বিবাহ বৈধ নয়। দেনমোহরের বিষয়ে মুসলিম আইনের ২৮৫- ৩০৬ ধারায়, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ১০ ধারায় উল্লেখ রয়েছেÑ দেনমোহর বা মোহরানা হলো কিছু টাকা অথবা অন্য কোনো সম্পত্তি যা বিবাহের প্রতিদান হিসেবে স্ত্রী তার স্বামীর নিকট হতে পাওয়ার হকদার হয় (ধারা-২৮৫ )। দেনমোহরের নির্দিষ্ট কোন পরিমাণ নেই, তবে হানাফী মাযহাবে এর সর্বনি¤œ পরিমাণ ১০ দিরহাম (ধারা- ২৮৬)। দেনমোহর বিবাহের পূর্বে অথবা বিবাহ কালে কিংবা বিবাহের পরেও নির্দিষ্ট করা যায় (ধারা-২৮৭)। উল্লেখ্য দেনমোহরের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা না থাকলেও স্ত্রী উপযুক্ত দেনমোহর পাওয়ার হকদার বটে (ধারা ২৮৯)।
এক্ষেত্রে স্ত্রীর পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের দেনমোহরের পরিমাণ ও তার সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করতে হয়। দেনমোহরের দাবী প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারণত দাম্পত্য মিলন, বৈধ নির্জনতা অথবা স্বামী /স্ত্রীর মৃত্যু দ্বারা [ধারা ২৮৯(ক)]। দেনমোহর সাধারণত ২(দুই) প্রকার। ১. আশু বা তলবী এবং ২. বিলম্বিত বা স্থগিত দেনমোহর। তলবী দেনমোহর স্ত্রী কর্তৃক দাবীর সঙ্গে সঙ্গে স্বামী তা পরিশোধ করতে বাধ্য এবং তা পরিশোধ না করলে স্ত্রী তার স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন পালন করতে বাধ্য নয়। অন্যদিকে বিলম্বিত দেনমোহর বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যু পর স্ত্রী পাওয়ার হকদার হয় (ধারা ২৯০)। তবে একজন স্ত্রী তার পুরো বা আংশিক দেনমোহর মওকুফ করতে পারেন (ধারা- ২৯১)। কোন স্বামী তার স্ত্রীর দেনমোহরের টাকা পরিশোধ না করে মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীগণ আনুপাতিক হারে দেনমোহর পরিশোধ করার ব্যাপারে দায়ী থাকেন (ধারা -২৯৪) এবং একজন বিধবা তার মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে দেনমোহরের টাকা আদায় করতে পারেন (ধারা-২৯৫) এবং দেনমোহরের টাকা সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত একজন বিধবা তার স্বামীর সম্পত্তি দখলে রাখতে পারেন ( ধারা-২৯৬)। কিন্তু এ রকম দখলের ফলে উক্ত সম্পত্তিতে তার মালিকানা স্বত্ব সৃষ্টি হবে না (ধারা-২৯৮)। এক্ষেত্রে বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তির আয়-ব্যায়ের হিসেব স্বামীর অন্যান্য ওয়ারিশদের বরাবর প্রদান করতে বাধ্য থাকেন (ধারা-৩০০)।
অন্যদিকে ধর্মীয় ও প্রচলিত আইনে ভরন-পোষণ বা খোর-পোষের দায়িত্ব বিভিন্ন অবস্থায় ব্যক্তির উপর বর্তায়। ভরণ-পোষণ বা খোরপোষ বলতে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও নিত্য প্রয়োজনীয় আনুসঙ্গিক জিনিসপত্রকে বুঝায়। ইসলামী পরিভাষায় খোরপোষ বা ভরনপোষণকে নাফকা বলে। নাফকার শাব্দিক অর্থ ব্যয় করা। মানুষ পরিবার-পরিজনের জন্য যা ব্যয় করে তাকে নাফকা বা খোরপোষ বলা হয় (ধারা-৩৬৯)। খোরপোষের বিষয়ে মুসলিম আইনের ২৭৭ -২৮০ ধারায় এবং স্ত্রীর খোরপোষের বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৯ ধারায়ও উল্লেখ রয়েছে। স্ত্রীকে খোরপোষ প্রদানে তার স্বামী বাধ্য। স্বামী যতই গরীব হোকনা কেন এ দায়িত্ব স্বামীর একান্ত ব্যক্তিগত। একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তখনই খোরপোষ প্রদানে বাধ্য যখন উভয়ের মধ্যে বৈধ বিবাহ বলবৎ থাকে এবং স্ত্রী তার স্বামীর অনুগত থেকে একত্রে বসবাস করে অথবা কোন যৌক্তিক কারনে স্ত্রী অন্যত্র বসবাস করে। অন্যদিকে কোন স্ত্রী যখন তার স্বামীর অনুগত না থেকে কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়া অন্যত্র বসবাস করে তখন স্বামী তার স্ত্রীকে খোরপোষ প্রদানে বাধ্য নয় ( ধারা-২৭৭)। একজন বিবাহিতা স্ত্রী বিবাহ বলবৎ থাকাকালীন এবং তালাকের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে ইদ্দতকাল পালন পর্যন্ত খোরপোষ দাবি করতে পারেন (ধারা-২৭৯)। অন্যদিকে সন্তান সন্তুতির ক্ষেত্রে পুত্র সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত এবং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে সাবালিকা ও বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তাদের পিতা, যদি পিতার আর্থিক সংগতির চেয়ে মায়ের আর্থিক সংগতি বেশী হয় সে ক্ষেত্রে তাদের মাতা, যদি মাতা- পিতার আর্থিক সংগতির চেয়ে দাদার আর্থিক সংগতি বেশী হয়, সে ক্ষেত্রে দাদা তাদের খোরপোষ বহন করবেন (ধারা-৩৭০)। তাছাড়া সচ্ছল হোক আর অসচ্ছল হোক সাবাল ছেলে ও সাবালিকা মেয়ে তাদের পিতা-মাতাকে খোরপোষ প্রদানে বাধ্য (৩৭১)। এছাড়া কোন ব্যক্তি তার আপন দাদদাদীর খোরপোষ প্রদানে বাধ্য (৩৭২) এবং সচ্ছল ব্যক্তিগন তাদের গরীব আত্মীয় সজনের খোরপোষ প্রদানে বাধ্য (ধারা- ৩৭৩)।
আইনজীবী
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট