সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৫ বৈশাখ ১৪৩২
সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫
বঙ্গবন্ধুর আমলের প্রবৃদ্ধি ছিল সর্বোচ্চ
রেজাউল করিম
প্রকাশ: শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪, ১০:৩৪ AM
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে ভাষণ দেন তাতে তিনি বলেন, ‘এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবকরা কাজ না পায়।’ বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন ছিল, দেশে দারিদ্র্য বলে কোনো শব্দ থাকবে না।

প্রতিটি মানুষ আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে। এখানে কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না। কেউ কাউকে শোষণ করবে না। বঞ্চিত করবে না তার প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার থেকে। এ জন্য তিনি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কাঠামোর মধ্যে আনতে চান। এ জন্য তিনি গ্রাম পর্যায়ে সমবায় গঠন, তহবিল, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা প্রভৃতিকে কাঠামোর রূপরেখায় নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের কৃষি জমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মালিকানায়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত, জমির সীমানা বা আইল খুঁটি দ্বারা চিহ্নিত। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বৃহৎ চাষাবাদ বিঘ্নিত। তাই তিনি  প্রতিটি গ্রামে সমবায় সমিতি গঠনের উদ্যোগ নেন।

বঙ্গবন্ধু কৃষিকে উজ্জীবিত করতে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে তিনি কৃষিবিদদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ সবাই একই বেতন স্কেল পাবেন, একই মর্যাদা পাবেন।’ অর্থাৎ কৃষিবিদদের তিনি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেন। তিনি আরো বলেন, ‘ফুল প্যান্ট নয়, তোমরা হাফ প্যান্ট পরে মাঠে নামবে। কৃষকের কাছ থেকে আগে কৃষি শিখবে। কৃষিকে তোমাদেরই উজ্জীবিত করতে হবে।’ তিনি প্রকাশ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ডাক দিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কৃষি পাঠ্যসূচিকে যুগোপযোগী করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আপনারা কোর্স কারিকুলাম এমনভাবে তৈরি করুন, যাতে আমরা খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারি। ১ ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না।’

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তখন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাইনাসে, -১৩.৯৭। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয় ৩.৩৩%। অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয় (১৩.৯৭+৩.৩৩)=১৭.৩০%। ১৯৭৪ সালে হয় বন্যা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য সহায়তা দিতে চেয়েও দেয়নি। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। তারপরেও সে বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯.৫৯। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তারপরেও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয় ৯.৮৮%। বঙ্গবন্ধু পুরো বছর বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ডাবল ডিজিটে চলে যেত। জাতির পিতার আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি ছিল তা আজও অতিক্রম করা যায়নি। অতিক্রম তো দূরের কথা তা ধরেও রাখা যায়নি।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয় ৫.৬৬%। ১৯৭৭ সালে ২.৬৭%, ১৯৭৮ সালে ৭.০৭%, ১৯৭৯ সালে ৪.৮%, ১৯৮০ সালে ০.৮২%, ১৯৮১ সালে ৭.২৩%। ১৯৮২-১৯৯০ গড়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৫.৯৪%। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১৫২ ডলার, ভারতের ১২৩ ডলার, বাংলাদেশের ৯৪ ডলার। কোন কোন বইতে আছে ৮৮ ডলার। ১৯৭৩ সালে ভারতের ১৪৪ ডলার, বাংলাদেশের ১২০, পাকিস্তানের ১০০ ডলার। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ১৮২, ভারত ১৬৩, পাকিস্তান ১৩৫ ডলার। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ২৭৮, পাকিস্তান ১৬৮, ভারত ১৫৮ ডলার। বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারত, পাকিস্তানকে ছাপিয়ে যায়। এটাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণ। 

বঙ্গবন্ধুর নিহতের এক বছরের মাথায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৭৮ থেকে কমে হয় ১৪১ ডলার। ১৯৭৭ সালে আরো ১০ ডলার কমে হয় ১৩১ ডলার। ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় হয় ১৯১ ও ভারতের ১৬১ ডলার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ কখনো মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে পাকিস্তানকে অতিক্রম করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আমলে ২০১৫ সালে পুনরায় মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে অতিক্রম করে। এখন (২০২৩ সালে) বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৭৯৩, ভারত ২৬০১, পাকিস্তান ১৬৫৮ ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৩২৪.২ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তান ২৬৩.৬ বিলিয়ন ডলার, ভারত ২৬২২.৯ বিলিয়ন ডলার (২০২০ সালের তথ্য)। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে পূর্ব বছরের তুলানায় মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ঘটে ১৯৭৫ সালে ৫২.৭৫%। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৭৪ সালে ৫১.৬৭%, তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৯৭৩ সালে ২৭.৬৬%। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এ সাড়ে তিন বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ৪৪%। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ কতদূর যেতো?’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন অর্থনীতির এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১১ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়াত ১৪১০০ ডলারের উপরে। কিন্তু সে সময় বাস্তবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ২৪৫ ডলার। মাথাপিছু ১২০০০ ডলার হলে তাকে উন্নত দেশ ধরা হয়। 

অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত তার ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ’ বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি অর্থশাস্ত্রের নানা তত্ত্ব-উপাত্ত উপস্থাপন করে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এবং তাঁর শাসন অব্যহত থাকলে আজ অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে মালয়েশিয়াকে টপকে যেত বাংলাদেশ,২০১১ তেই বাংলাদেশের মাথাপিছু প্রকৃত আয় ১৪ হাজার ১০০ ডলারে পৌঁছাত বলে জানিয়েছেন আবুল বারকাত। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের সম্ভাব্য পরিমাণ হতো ৪২ হাজার ১৫৮ কোটি ডলার। কিন্তু বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে সেই জিডিপির পরিমাণ মাত্র ৮ হাজার ৮৫৫ কোটি ডলার (২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী)। অথচ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে মাথাপিছু আয় রেখে গিয়েছিলেন ২৭৮ ডলার। তা অতিক্রম করতে বাংলাদেশের সময় লেগেছে ১৪ বছর। ১৪ বছর পরে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হয় ২৮৬ ডলার।

অর্থনীতিবিদ বারকাত বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন গ্রামের মানুষের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলে বাংলার প্রতিটি গ্রামের চিত্র আমূল পাল্টে যেত। সংগত কারণেই তখন গ্রামকে আর গ্রাম বলা যেত না। বর্তমানে ৭২ শতাংশ গ্রামে বাস করে অন্যদিকে শহরে থাকেন মাত্র ২৮ শতাংশ। আবুল বারকাত দেখিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই চিত্রটাই একেবারে উল্টো হয়ে যেত। তখন ৭৫ জন শহরবাসীর বিপরীতে গ্রামে বাস করতেন মাত্র ২৫ জন মানুষ।

বঙ্গবন্ধু পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন যাতে মানুষে মানুষে ধন সম্পদের ব্যবধান যেন চরমভাবে বৃদ্ধি না পায়। সমাজতন্ত্র বলতে বঙ্গবন্ধু মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন, মাও, কিম ইল সু বা কাস্ত্রোর সমাজতন্ত্র বোঝাননি। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র বলতে শোষণহীন সমাজের কথা বুঝিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, ‘সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুর। তবে সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনোদিন সমাজতন্ত্র হয় না; তা যারা করেছেন, তাঁরা কোনোদিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। কারণ লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না, যেমনÑ তা পড়ে আন্দোলন হয় না। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে সেই দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কী আবহাওয়া, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয়।’ সেজন্য তিনি সে পথে হাঁটতেছিলেন। দেশের বৃহৎ কলকারখানা, ব্যাংক, বিমা জাতীয়করণ করেছিলেন। তারপর তিনি বাকশাল কর্মসূচি হাতে নেন, যার লক্ষ্য ছিল শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা। অবশ্য বাকশাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের পূর্বেই তিনি নিহত হন। 

তিনি শুধু একটি স্বাধীন দেশের সূচনা করেননি; সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে রেখে গেছেন অর্থনৈতিক দর্শন। স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। কৃষিবিপ্লবসহ কৃষিখাতে সংস্কার ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। আজকের বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কৃষি, ব্যাংক-বীমা, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ—সব বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে গেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধু অর্থনীতিতে সফল ছিলেন না। বিষয়টি সত্য নয়। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক সাফল্য ছিল অকল্পনীয়, ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর অর্থাৎ ১ হাজার ৩১৪টি দিন দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত এদেশকে ধ্বংসস্তুপ থেকে টেনে তুলেছিলেন তিনি। একারণেই প্রশ্ন জাগে, পঁচাত্তরের সেই কালরাত যদি না আসত তাহলে বাংলাদেশ আজ কোথায় থাকত?

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সম্পাদক, এনসিটিবি

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত