যশোরের কেশবপুরে অধিকাংশ ইটভাটায় রাসায়নিক ক্যামিক্যাল দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইট ১ নম্বর করতে ভাটার মালিকরা পরিবেশ দূষণকারী ওই রাসায়নিক ক্যামিক্যাল ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে।
কেশবপুরে ১৩টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে ১১টিই অবৈধ। এসব ভাটার মালিকরা পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই, কোন রকম নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে তাদের অধিকাংশ ভাটা, ফসলী জমি, বিদ্যালয়, সড়ক এবং লোকালয়ের পাশে নির্মাণ করেছেন। এতে ফসল উৎপাদন ব্যহতসহ পরিবেশ দুষিণের কারনে স্বাসকষ্ট জনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এলাকাবাসী। কেশবপুরের আগরহাটি প্রাণ ব্রিকস, গৌরিঘোনায় এসএসবি ব্রিকস, আগরহাটি ভরত ভায়নায় হামজা (রয়েল) ব্রিকসে ওই রাসায়নিক ক্যামিক্যাল ব্যবহার করা হলেও দেখার কেউ নেই। ভাটার মালিকরা সংশ্লিষ্ট সকলকে ম্যানেজ করেই তারা তাদের ইট ভাটায় ইট পুড়িয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা মালিক হলেও সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব।
জানা যায়, কেশবপুর উপজেলার বায়সা-কালিবাড়ি গাজি ব্রিকস, গোল্ড ব্রিকস, সন্নাসগাছা বিউটি-১, বিউটি-২, বগা গ্রামে সরকারি সড়কসংলগ্ন ও মাদ্রাসার পাশে অবস্থিত ডিএসবি ব্রিকস, বারইহাটি গ্রামে রোমান ব্রিকস, মির্জানগরে রহমান ব্রিকস ও আলম ব্রিকস, সাতবাড়িয়ায় সুপার ব্রিকস, গৌরিঘোনায় এসএসবি ব্রিকস, আগরহাটি ভরত ভায়নায় হামজা (রয়েল) ও প্রান ব্রিকসসহ মোট ১৩টি ইটভাটা রয়েছে।
এরমধ্যে গাজী ব্রিকস ও কেশবপুর ব্রিকসসহ ২টি ইট ভাটার বৈধ কাগজপত্র আছে বলে দাবী করেন স্থানীয় ইটভাটা মালিক সমিতি। ভাটার মালিকরা তাদের ভাটা নির্মানে পরিবেশের ছাড়পত্রসহ সরকারী কোন অনুমতি ছাড়াই সংশ্লিষ্ট সকলকে ম্যানেজ করে তাদের ইট ভাটায় কাঠ, কয়লা ও রাস্য়ানিক ক্যামিক্যাল দিয়ে ইট পুড়িয়ে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়ে আসছে। ভাটার মালিকরা কোন রকম বাঁধা ছাড়াই তাদের ভাটার সামনে সেম্পল হিসেবে কিছু কয়লা ফেলে রেখে দিনে কয়লা এবং রাতে কাঠ ও রাসায়নিক ক্যামিক্যাল দিয়ে ইট পোড়াচ্ছে। সূত্র জানায়, ক্যামিক্যাল দিয়ে ইট পোড়ালে সব ইট ১ নম্বর হিসেবে পাওয়া যায়। তাতে লাভও বেশী হয়। কিন্তু এতে ইটের টেম্পার ভাল হয় না এবং ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে।
এদিকে উপজেলার আগরহাটি প্রাণ ব্রিকসটি আফার ভদ্রা নদীর দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। নদীর উত্তর পাশে খুলনা জেলা এবং দক্ষিন পাশে যশোর জেলার অংশে অবস্থিত। এই ভাটার মালিক প্রতিবছর নদীর দক্ষিন পাশের অংশের পাড়ে মাটি ফেলে নদীর প্রায় অর্ধেক এলাকা ভরাট করে সেখানে অবৈধ ভাবে প্রাণভাটা নির্মান করে নদীটি আস্তে আস্তে দখলে নিচ্ছে। এই ভাটার মালিক সাইফুল ইসলাম আফার ভদ্রা নদী ভরাট করে এরই মধ্যে প্রায় ২০ বিঘা সরকারি জমি দখলে নিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রাণ ব্রিকসের মধ্যেই রাসায়নিক ক্যামিকেলের বস্তা সাজিয়ে রাখা আছে। এর ছবি তুলতে গেলে ভাটার লোকজন সাংবাদিকদের বাঁধা দেয়। সরকারি ওই জমি দখলমুক্ত করতে সংশ্লিষ্ঠ ইউনিয়ন ভুমি অফিস থেকে ভাটার মালিক সাইফুল ইসলামকে কয়েক দফা নোটিশ দিলেও তিনি তাতে কর্নপাত করছেন না বলে, স্থানীয় ভুমি অফিসের নায়েব এই প্রতিনিধিকে জানান। এছাড়া ভাটার কালো ধোয়াই এলাকায় ফসলের ক্ষতিসহ ফলজ-বনজ গাছ উজাড় হয়ে বনাঞ্চল হুমকির মুখে পড়েছে। এর পাশাপাশি পরিবেশ দূষিত হয়ে রোগ-বালাই ছড়াচ্ছে বলে একাবাসীরা জানান। এইসব ভাটা বন্ধে এলাকার কৃষকরা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক বার অভিযোগ করলেও আজ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। অন্যদিকে ভাটার বায়ূদুষন রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী ইট ভাটা নির্মানে প্রতিটি ইটভাটার চিপনি ১২০ ফুট উচুঁ করে নির্মাণ করার কথা থকলেও কোন কোন ইট ভাটার মালিক তা-না করে ৩০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু করে চিপনি নির্মান করেছেন।
এছাড়া ভাটার ওই চিপনি ভাটার ক্লিনের একপাশে ¯হাপনসহ তার ভিতরের অংশে পানি রাখার ব্যব¯হা রাখার কথা থাকলেও তারা তা মানছেন না। পানির ব্যব¯হা রাখলে কার্বন ডাই অক্্িরইড তৈরি কম হয়। এতে পরিবেশ বান্ধব সাদা ধোয়া বের হয়। ফলে দূষণের মাত্রা অনেক কম হয়। এসব নিয়ম-কানুনের প্রতি কোন তোয়াক্কা না করে ভাটার মালিকরা তাদের ভাটায় চিপনি ইটভাটার মাঝখানে স্থাপন করেছেন। ফলে ওইসব ভাটায় অতিরিক্ত দূষণে এলাকার কোমল মতি শিশু, ভাটা সংলগ্ন বসবাসকারী মানুষেরা স্বাসকষ্ঠসহ দুষণজণিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এরমধ্যে বগার ডিএসবি, বারইহাটিতে রোমান ব্রিকস, আগরহাটির প্রাণ ব্রিকস, বেগমপুরে রিপন ব্রিকস, সন্নাসগাছায় বিউটি-১ ও বিউটি-২ ব্রিকসের চিপনি মাত্র ৩০ থেকে ৬০ উচুঁ করে নির্মান করা হয়েছে। যা পরিবেশের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর বলে পরিবেশ বিদরা মনে করেন। এব্যাপারে জানতে চাইলে অধিকাংশ ভাটার মালিকরা বক্তব্য দিতে অপরকতা প্রকাশ করেন।
এলাকাবাসী অবৈধ এসব ইটভাটা বন্ধসহ ভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
উপজেলা ভালুকঘর গ্রামের কৃষক সাহেবালী বলেন, ভাটার কালো ধোয়াই জমিতে থাকা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া ভাটার দুষনে স্বাসকষ্ট জনিক রোগসহ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আগরহাটি গ্রামের কৃষক রহমত আলি বলেন, ভাটার মালিকরা তাদের ভাটায় ইট ভাল করতে ক্যামিক্যাল ব্যবহার করছে। এসব ভাটা থেকে কালো ধোয়া বের হচ্ছে। তাতে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
কলেজ শিক্ষার্থী রাসেল ও মিলন বলেন, ভাটার কালো ধোয়ই বায়ুদূষণে মানুষের স্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্তসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এসব ইটভাটা বন্ধ করতে তারা সংশ্লিষ্ট উদ্ধর্তণ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানান।
প্রাণ ভাটার মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রাণ ভাটাটি আফার ভদ্রা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। নদীটি যশোর ও খুলনা জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। ওই নদীর ভরাট হওয়া সরকারি জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য স্থানীয় নায়েব আমাকে নোটিশ দিয়েছেন। আমি তার সাথে দেখা করে বলেছি এবার ভাটার মৌসুম শেষে নদীর জমি ছেড়ে দেব। এছাড়া ক্যামিক্যাল দিয়ে ইট পোড়ালে ইটের কালার ভাল হয়। যেহেতু আপনারা এসেছেন তাই আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ক্যামিক্যালের সব বস্তা সরিয়ে ফেলা হবে।
বগার ডি এসবি ভাটার মালিক আব্দুল হাকিম বলেন, আমার ভাটাটি ৮/৯ বছর আগে কেশবপুর ভায়া পাটকেলঘাটা সড়কের সাথে নির্মান করা হয়। সেই থেকে সকলকে ম্যানেজ করে ভাটায়টি চলছে। এছাড়া ভাটা নির্মাণে আমার ভাটা কেন, কোন ভাটারই পরিবেশের ছাড়পত্র নেই।
কেশবপুর ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি, আরমান গাজী বলেন, কেশবপুরে বর্তমানে ১৩টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে গাজী ব্রিকস ও কেশবপুর ব্রিবসসহ ২/৩টি ভাটার বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। অন্যগুলো বিভিন্ন ভাবে ম্যানেজ করে চলছে। এছাড়া ২০২১ সাল থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর ভাটা নির্মানে পরিবেশের ছাড়পত্র দিচ্ছেনা বলে তিনি এই প্রতিনিধিকে জানান।
উপজেলার ৯নং গৌরিঘোনা ইউনিয়ন সহকারি ভুমি কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আগরহাটি আফার ভদ্রা নদীর পাড়ে অবস্থিত। ভাটাটি সরকারি জমিসহ আফার ভদ্রা নদী ভরাট করে প্রায় ২০ বিঘা সরকারি জমি দখল করে নিয়েছে।
সরকারি জমি উদ্ধারের জন্য ভাটার মালিককে কয়েক দফা নোটিশ করা হলেও তিনি সরকারি জমি ছাড়ছেন না। এব্যাপারে উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ক্রমে সরকারি জমি উদ্ধারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।