বিশ্বব্যাপী জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬-৮ শতাংশ শুধু শিক্ষার জন্য বরাদ্দের কথা বলা হয়, কিন্তু দেশে বরাবরই প্রয়োজনের তুলনায় কম বরাদ্দ দেওয়া হয় শিক্ষাখাতে। বিশ্বের চ্যালেঞ্জিং অথনীতির মুখে আমাদের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে বাজেট করা কঠিন কাজ।
অথর্নীতির প্রচলিত নিয়মে একে বাঁধা যায় না। যে হারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, বাড়ছে এবং বাড়বে তা কোনো অর্থনৈতিক নিয়ম মেনে হচ্ছে না। এটি কার বা কাদের নিয়ন্ত্রণে সেটিও বলা কঠিন। তবে, জনগণ রাষ্ট্রের কাছেই দাবি করবে এটিই স্বাভাবিক।
দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের সাফল্যের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আয় ও সম্পদবৈষম্য। আয়বৈষম্যের পেছনে বহু কারণ ও প্রক্রিয়া কাজ করছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মজুরি ও বেতন থেকে প্রকৃত আয় হ্রাস পাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যানের একাধিক উৎস থেকে দেখা যায় যে গত ১০ বছরে মজুরি ও বেতন থেকে প্রকৃত আয় এমনকি অনেক পেশায় নামিক আয় কমেছে।
বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ থেকে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি, বেড়েছে কৃষিতে এবং সেখানে নিয়োজিত ব্যক্তিপ্রতি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে। স্কুল শিক্ষাক্রমে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে সে বিষয়ে নিয়োগকারীদের মতামত নেয়া জরুরি। উন্নয়ন বাজেটে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ অংশ বৃদ্ধি করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করতে হবে। নিম্ন-আয়ের পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুলে বিশেষ সহায়ক কার্যক্রম গ্রহণ করে তাদের অর্জন বাড়াতে হবে। বর্তমানে শিক্ষার যে পারিবারিক ব্যয় তা নিম্ন-আয়ের পরিবারে এক বিশাল বোঝা।
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সেবাখাতে অর্থ বরাদ্দের যে পরিকল্পনা সেটাই সাধারণত বাজেট। একটি দেশের জনসংখ্যা, আর্থসামাজিক অবস্থা, কর্মক্ষম মানুষের দক্ষতা, কার্যসম্পাদনে অধিক মনোযোগী, বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী উৎপাদন এ বিষয়গুলোকে দ্রুত ত্বরান্বিত করার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দ করা হয়। তবে একটি দেশের জনসংখ্যা ও আর্থসামাজিক অবস্থার উপর বাজেট অনেকাংশে নির্ভর করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে শিক্ষায় দেশ এগিয়ে গেলেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আত্মকর্মসংস্থান ও বেকারত্বের অবসানের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বাজেটে বেকার সমস্যার সমাধানের দিক নির্দেশনা থাকা উচিত। রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক, মেধা মননের বিকাশের ক্ষেত্রে যে কয়েকটি খাত রয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। এ খাতটি একটি রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রতিটি নাগরিকের মেধা, চিন্তা, শক্তি স্বাভাবিক জীবনবোধের জাগরণের সাথে সম্পৃক্ত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যভাবে এ খাতের উন্নয়ন কল্পে যা যা পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তা থেকে রাষ্ট্রে অনেক দূরে। বড় সমসা আমাদের শিক্ষার উন্নতি কল্পে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ খুবই কম। অথচ আমাদের পাশ্চাত্য দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কায় শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণের চেয়ে বাংলাদেশে অত্যন্ত কম। বাংলাদেশে এমন কিছু খাত আছে যেখানে বরাদ্দ অনেক অথবা উৎপাদনশীল খাত নয় সেখানে বরাদ্দ বাড়ানো হয় আর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ে না বরং কমেবিপুল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার যে, মহান দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত তারা সমাজের শিক্ষক হিসাবে পরিচিত।
শিক্ষকরাই পারেন একটি অন্ধকার সমাজকে আলোকিত করতে। সমাজ রাষ্ট্রের এই গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন শিক্ষক সমাজ। বর্তমান দেশে ৫ লাখ শিক্ষক রয়েছেন যারা সরকারি বেতন-ভাতাদি পেয়ে থাকেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক নামে পরিচিত। এ সমস্ত শিক্ষকরা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষায় প্রায় শতভাগ পাসসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন অগ্রগতির অংশীদার শিক্ষকরা। যদিও বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা গণমুখী ও সার্বজনীন এবং সমতাভিত্তিক নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি-বেসরকারি শব্দ দিয়ে যে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে তা সংবিধান পরিপন্থি। মুক্তিযুদ্ধে পোড়ামাটি ও বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও শিক্ষকদের কথা ভেবেছেন। সে সময় প্রথম বাজেটেই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখেন ৭ শতাংশেরও বেশি। এমনকি এ বরাদ্দ সামরিক খাতের চেয়েও বেশি ছিল।
বঙ্গবন্ধু শিক্ষাখাতে বিনিয়োগকে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ বলে অভিহিত করেন। বর্তমান শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তার পুরোটা শিক্ষাখাতে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাখাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন যার নেতৃত্বে ছিলেন ড. কুদরাত-ই খুদা।তারপর বিশ্ববিদ্যালয় মুঞ্জুরী কমিশন গঠন, প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা শিক্ষার প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ করে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বঙ্গবন্ধুর হাতে-গড়া আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্রের ক্ষমতায়। তাই শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি মর্যাদাও দিতে হবে শিক্ষকদের। আর্থসামাজিক, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে হলে শিক্ষকদের উন্নয়নের বিকল্প নেই। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, বৈষম্য দূরীকরণ ও শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে এ বৈষম্য দূর করা সম্ভব।
শিক্ষা শুধু যে মানবজাতির পরিবর্তন ঘটায় তা নয়, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ন্যায়বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।
যেকোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করেন শিক্ষকরা। তাই বর্তমান শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের আরো দায়িত্বশীল হয়ে পাঠদান করতে হবে। দেশ শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্ত দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা বৈষম্য রয়েছে। প্রতিটি সরকার শিক্ষাকে কিভাবে জাতি গঠন ও উন্নয়নের ভিত্তি হিসাবে গড়ে তোলা যায় সে লক্ষ্যে শিক্ষানীতি প্রনয়ন করেন। শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সিলেবাস পরিবর্তন, শিক্ষার ক্যারিকুলাম ও পদ্ধতি নিয়ে যত চিন্ত-ভাবনা অর্থ ব্যয় হয় সে তুলনায় শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই।
দেশের সরকারি বেসরকারি শিক্ষকদের নানা বৈষম্য বিদ্যমান। উন্নত রাষ্ট্রে শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়। তাদের কোন বিষয়ে আন্দোলন করতে হয় না। শিক্ষার মাধ্যমে যেহেতু একটি দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যায় মানুষকে মানবীয় গুনাবলিতে গুনান্বিত করে মূল্যবোধ জাগ্রত করে তাই শিক্ষাব্যবস্থা অর্থ বরাদ্দ আরও বাড়ানো দরকার। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যে দেশ যত বেশি শিক্ষকদের নিয়ে ভাবেন, শিক্ষকদের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধিতে আন্তরিক সে দেশ তত উন্নত। তাই উন্নত রাষ্ট্রের শিক্ষকরা যেমন অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী তেমনি তাদের সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়।
একটি উন্নত আধুনিকীকরণ, বিজ্ঞানমনষ্ক ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারে একটি উন্নত যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা যা বাস্তবায়ন করবে শিক্ষকরা। কিন্তু শিক্ষকরা যদি আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে তাহলে শ্রেণিকক্ষে তারা চিন্তিত মন নিয়ে কীভাবে শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর সরকারের ওপর বর্তায়।
অতীতের বাজেটগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, শিক্ষাখাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানোন্নয়নে ভৌত অবকাঠামোগত অবস্থার উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির জোগান দিয়ে শিক্ষাবিস্তারে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এবারের বাজেটেও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মৌলিক চাহিদাগুলো বাস্তবায়নে সরকার সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে- এটাই আমাদের ও প্রত্যাশা।