মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫ ৯ বৈশাখ ১৪৩২
মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫
বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ
প্রদীপ সাহা
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১১:০০ AM
স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এসআইপিআরআই) শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। এ প্রতিষ্ঠানটি হল স্টকহোমভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এটি সশস্ত্র সংঘাত, সামরিক ব্যয় এবং অস্ত্র ব্যবসার পাশাপাশি নিরস্ত্রীকরণ এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য ডেটা, বিশ্লেষণ এবং সুপারিশ সরবরাহ করে। 

সম্প্রতি এসআইপিআরআই-র এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালে সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে বিশ্বের দেশগুলো এবং সামরিক ব্যয় ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হয়েছে। ২০০৯ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বের সব ভৌগলিক অঞ্চলে সামরিক ব্যয় বেড়েছে।

বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের ৩৭ শতাংশ খরচ করে শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালে দেশটি ৯১৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, যা আগের বছরের (২০২২) তুলনায় ২ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। তালিকায় এরপর আছে চীন। চীনের সামরিক ব্যয় ২৯৬ বিলিয়ন ডলার (বিশ্বের মোট ব্যয়ের ১২ শতাংশ), রাশিয়া ১০৯ বিলিয়ন ডলার (বিশ্বের মোট ব্যয়ের ৪ দশমিক ৫ শতাংশ), ভারত ৮৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার (বিশ্বের মোট ব্যয়ের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ) এবং সৌদি আরব ৭৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার (বিশ্বের মোট ব্যয়ের ৩ দশমিক ১ শতাংশ)। এছাড়া যুক্তরাজ্য ৭৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন, জার্মানি ৬৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন, ইউক্রেন ৬৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন, ফ্রান্স ৬১ দশমিক ৩ বিলিয়ন, জাপান ৫০ দশমিক ২ বিলিয়ন, ইসরায়েল ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন এবং পাকিস্তান ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। 

আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, এশিয়া, ওশেনিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা সব অঞ্চলেই সামরিক ব্যয় বেড়েছে। শতাংশের হিসাবে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি সামরিক ব্যয় বেড়েছে কঙ্গোতে অর্থাৎ ১০৫ শতাংশ। দেশটির সামরিক বাহিনী বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এসআইপিআরআই-র গবেষক চিয়াও লিয়াং জানান, মেক্সিকো এবং এল সালভাদোরে সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গ্যাং সহিংসতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। 

ইকুয়েডর এবং ব্রাজিলেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সালে ইউক্রেন সামরিক খাতে ৬৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, যা আগের বছরের (২০২২) তুলনায় ৫১ শতাংশ বেশি। তবে দেশটি ২০২৩ সালে ৩৫ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা পেয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে ইউক্রেন ২০২২ সালে সামরিক খাতে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। একই সময়ে রাশিয়া খরচ করেছে ১০৯ বিলিয়ন ডলার। তবে জিডিপির হিসাব করলে দেখা যায়, ইউক্রেন তার জিডিপির ৩৭ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করেছে। সেই তুলনায় রাশিয়ার ব্যয় হয়েছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। ফলে যুদ্ধটা রাশিয়ার চেয়ে ইউক্রেনের ওপর বেশি বোঝা হয়ে উঠেছে। 

দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনার কারণে ২০২৩ সালে সামরিক ব্যয় বেড়েছে। চীন তার খরচ আগের বছরের তুলনায় ৬ শতাংশ বাড়িয়ে ২৯৬ বিলিয়ন ডলার করেছে। এশিয়া ও ওশেনিয়া এলাকায় মোট সামরিক ব্যয় অর্ধেক করেছে চীন। এসআইপিআরআই-র গবেষক লিয়াং জানান, চীন পিপলস লিবারেশন আর্মিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। সামরিক ব্যয় বাড়ানোর কারণে জাপান, তাইওয়ান এবং ভারত তাদের সামরিক বাজেট বাড়িয়েছে। জাপান ৫০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং তাইওয়ান ১৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করেছে। তারা তাদের সামরিক বাজেট ১১ শতাংশ বাড়িয়েছে। 

সামরিক খাতে সৌদি আরব ২০১৮ সালে মোট ৬ হাজার ৭৬০ কোটি ডলার খরচ করেছে। ব্যয়ের দিক থেকে তাদের অবস্থান গোটা বিশ্বের মধ্যে তৃতীয়, আর উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। বিশ্বের সামরিক যন্ত্রপাতির সবচেয়ে বড় ক্রেতা তারা। বর্তমানে সৌদি আরবের মোট সামরিক সদস্য ২ লাখ ৩০ হাজার। তাদের আছে ৮৪৮টি যুদ্ধবিমান, ২৫৪টি হেলিকপ্টার, ১ হাজার ৬২টি ট্যাংক এবং ৫৫টি যুদ্ধ জাহাজ। তাদের কোনো সাবমেরিন নেই। সামরিক খাতে ২০২২ সালে ইরানের ব্যয় ছিল ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলার, যা ২০১৭ সালের তুলনায় সাড়ে নয় ভাগ কম। অবরোধ আর অর্থনৈতিক মন্দায় গত এক দশকে দেশটির অস্ত্র আমদানির পরিমাণ কমে গেছে।

২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তাদের আমদানিকৃত অস্ত্রের পরিমাণ ছিল সৌদি আরবের মাত্র সাড়ে তিন ভাগ। বর্তমানে দেশটির মোট সামরিক সদস্য ৮ লাখ ৭৩ হাজার। তাদের আছে ৫০৯টি যুদ্ধবিমান, ১৫৬টি হেলিকপ্টার, ১ হাজার ৬৩৪টি ট্যাংক, ৩৯৮টি যুদ্ধজাহাজ এবং ৩৪টি সাবমেরিন। ইসরায়েল ২০১৮ সালে সামরিক খাতে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। দেশটি নিজেই সামরিক অস্ত্র তৈরি করে। তাই তেমন একটা আমদানি করতে হয় না। ২০২৩ সালে দেশটি সর্বসাকুল্যে ১০৩ কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছে যুক্তরাষ্ট্র আর জার্মানির কাছ থেকে। দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬ লাখ ১৫ হাজার। তাদের আছে ৫৯৫টি যুদ্ধবিমান, ১৪৬টি হেলিকপ্টার, ২ হাজার ৭৬০টি ট্যাংক এবং ৬টি সাবমেরিন। 

সামরিক খাতে তুরস্ক ২০১৮ সালে মোট ১ হাজার ৮৯৭ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। এর মধ্যে ১১১ কোটি ডলার ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন ও ইতালিসহ ছয়টি দেশের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করে। তুরস্কের সামরিক বাহিনীর সদস্য ৭ লাখ ৩৫ হাজার। তাদের আছে ১ হাজার ৬৭টি যুদ্ধবিমান, ৪৯২টি হেলিকপ্টার, ৩ হাজার ২০০টি ট্যাংক, ১৯৪টি যুদ্ধজাহাজ এবং ১২টি সাবমেরিন। কাতারের সবশেষ সামরিক ব্যয়ের হিসাবটি ২০১০ সালের। সেই বছর তাদের বাজেট ছিল ২১৭ কোটি ডলার।

দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১২ হাজার। তাদের আছে ১০০টি যুদ্ধবিমান, ৪২টি হেলিকপ্টার, ৯৫টি ট্যাংক এবং ৮০টি যুদ্ধজাহাজ। ২০২৩ সালে ইরাক সামরিক বাহিনীর পেছনে প্রায় ৬৩২ কোটি ডলার খরচ করেছে। এর মধ্যে অস্ত্র ক্রয় বাবদ ১৫৬ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। তাদের আছে ১ লাখ ৬৫ হাজার সৈন্য, ৩২৭টি যুদ্ধবিমান, ১৭৯টি হেলিকপ্টার, ৩০৯টি ট্যাংক এবং ৬০টি যুদ্ধজাহাজ। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট ছিল ৬৪ হাজার ৮৮০ কোটি ডলার। তাদের রয়েছে প্রায় সাড়ে ২১ লাখ সামরিক সদস্যের বিশাল বাহিনী। তাদের এই পরাশক্তির বহরে আছে ১৩ হাজার ৩৯৮টি যুদ্ধবিমান, ৫ হাজার ৭৬০টি হেলিকপ্টার, ৬ হাজার ২৮৭টি ট্যাংক, ৪১৫টি যুদ্ধজাহাজ এবং ৬৮টি সাবমেরিন।    
     
জার্মানির ‘পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফ্রাঙ্কফুর্ট’ (পিআরআইএফ)-এর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিকলাস শ্যোরনিগ জানান, ‘আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন সামরিক নিরাপত্তা আবার অগ্রাধিকার পাচ্ছে এবং নিরাপত্তা ইস্যুটি সামরিক কাঠামোর ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে।’ ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলা এবং পরে ইরানে ইসরায়েলের হামলা চলছে। বর্তমান সময়ে হামলা চালানোর চেয়ে প্রতিরক্ষার বিষয়টি বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। বিশ্ব একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর কারণ বেশিরভাগ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি অনেক পুরানো এবং আর কার্যকর হচ্ছে না। সামরিক খাতে ব্যয়ের হিসাবটি তাই বেড়ে গেছে। 

লেখক : কবি ও কলামিস্ট


« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত