শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের ১০০ দিনের অর্জন নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত বিশ্লেষণ হচ্ছে। একটি সরকার পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। তার প্রথম ১০০ দিন নিয়ে কথা বলার তেমন কিছু থাকে না। ধারণাটার উৎপত্তি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে একজন নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে তাঁর ১০০ দিনের আলোচনা হয়। কারণ তিনি তাঁর সম্পূর্ণ প্রশাসনকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেন। গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিজের বিশ্বস্ত মানুষদের পদায়ন করেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশাসন অনেক বেশি সুবিধাভোগী ও শক্তিশালী।
এদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের মতো না হলেও বাংলাদেশে সরকারের ১০০ দিন চর্চা ইদানীং শুরু হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের একটি ধারাবাহিকতা আছে, যার শুরু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর। হিসাব করতে হলে আগের ধারাবাহিক তিন মেয়াদও বিবেচনায় নেওয়া শ্রেয়। হিসাবে নিতে হবে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শাসনকালও—যখন ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রথমবার এক বৈরী পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় আসে।
বৈরী এই কারণে যে আগের ২১ বছরে জিয়া-এরশাদ-খালেদা প্রশাসন সাজিয়েছিলেন তাঁদের বশংবদ কর্মকর্তাদের দিয়ে, যাঁদের অনেকেই ছিলেন সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সমর্থক। তার ওপর ছিল রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনার অনভিজ্ঞতা।
সালের শেখ হাসিনা আর বর্তমানের শেখ হাসিনা এক নন। তখন শেখ হাসিনা ছিলেন গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার পিচ্ছিল পথে পদার্পণকারী একজন প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে সহায়তা করার জন্য সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত বেশ কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। ছিলেন জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, সাজেদা চৌধুরী, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বা মোহাম্মদ আবদুল হামিদের মতো পোড় খাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁদের সহায়তায় এবং দেশের মানুষের ভালোবাসা ও অকুণ্ঠ সমর্থনে শেখ হাসিনা এক কঠিন সময় পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে দেশ পরিচালনায় তাঁর চলার পথের প্রতিটি পদে সংসদে বিরোধী দল ও তাদের মিত্র জামায়াত বাধা সৃষ্টি করতে চেয়েছে। দেশ অচল করার নানা অজুহাত খুঁজেছে। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে ২১ বছরে রাজনীতির সার্বিক চিত্র পরিবর্তন হয়ে দেশে রাজনীতির দুটি ধারা তত দিনে বেশ শক্তভাবে ভিত গেড়ে বসেছে। একাত্তরে যারা বাংলাদেশের জন্মই চায়নি, তাদের সমন্বয়ে এবং বিদেশি মদদে দেশে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী আওয়ামীবিরোধী জোট। পিতার মতো সাহস নিয়ে সব বাধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। তাঁর বড় সুবিধা ছিল তখনো চারপাশে এত চাটুকার, হাইব্রিড আওয়ামী লীগার আর ধান্দাবাজের সমাবেশ ঘটেনি।
প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনার দুটি বড় অর্জনের মধ্যে একটি ছিল ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি। অন্য আরেকটি যুগান্তকারী অর্জন ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের চলমান রক্তক্ষয়ী পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতের অবসান। এই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের শুরুটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়ার ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে।
১৯৭৭ সাল থেকে জিয়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদীভাঙা উদ্বাস্তুদের ট্রাক-বাস ভর্তি করে পার্বত্য অঞ্চলে স্থানান্তর শুরু করেন। এই সহায়-সম্বলহীন উদ্বাস্তুরা পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে নির্বিচারে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও চাষের জমি দখল করা শুরু করে। এখান থেকেই অশান্তির শুরু। অথচ শত বছর ধরে এখানে সমতলের মানুষ গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসতি স্থাপন করেছে, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে, মাঝেমধ্যে সংঘাত যে হয়নি তা নয়, তবে তা ছিল বিচ্ছিন্ন। কোনো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়া দলের কিছু নিবেদিত নেতার সহায়তায় পাহাড়ে দীর্ঘদিনের রক্তপাতের অবসান হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার ও জঙ্গি পাহাড়িদের সংগঠন ‘শান্তিবাহিনীর’ সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে।
১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশ-বিদেশের অসংখ্য টিভি ক্যামেরা ও সাংবাদিকের সামনে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা তাদের অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। সেটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
চুক্তি সম্পাদন ও অস্ত্র সমর্পণের আগে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা প্রচার শুরু করে, এই চুক্তির মাধ্যমে ফেনী নদী পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতের কাছে চলে যাবে। পরিকল্পনা ছিল চুক্তি সম্পাদনের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা ফেনীর বেশ কয়েক জায়গায় দরজির দোকান থেকে ভারতীয় পতাকা জব্দ করেন।
স্রেফ রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য বিএনপি ও তার মিত্রদের ভারতবিরোধিতা নতুন কোনো বিষয় নয়। এই মেয়াদে আরো একটি যুগান্তকারী অর্জন ছিল সংসদে সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা। এই আইন জিয়া সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন ১৫ আগস্টের ঘাতকদের তাদের অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য। জিয়া তাদের শুধু দায়মুক্তিই দেননি, নানাভাবে পুরস্কৃতও করেছিলেন। অনেকে শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন ঘাতকদের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হোক। তিনি তা নাকচ করে ঘাতকদের বিচার শুরু করেছিলেন উন্মুক্ত বিচারিক আদালতে। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে বিচারকাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
২০০১ সালের আওয়ামী লীগের পরাজয় অপ্রত্যাশিত ছিল না, যদিও ফল নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেকেই হতভম্ভ হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ (৪০.১৯ শাতাংশ) ও বিএনপি (৪০.৯৭ শতাংশ) প্রায় সমান ভোট পেয়েও বিএনপি বিজয়ী হয়েছিল ১৯৩টি আসনে আর আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসনে। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের একটি নতুন প্রজন্ম ক্ষমতায় এসে রাজনীতিচর্চার চেয়ে ক্ষমতার চর্চা করেছে বেশি। ফলে সংগঠন হয়েছে দুর্বল।
নির্বাচনের আগে তারা বুঝতে পারেনি ভেতরে ভেতরে তাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মহল ও সরকারের প্রশাসন আওয়ামী লীগকে পরাজিত করার জন্য কত বড় ষড়যন্ত্র করছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এই জোট ছিল অপ্রকাশ্যে, এবার তা হয় প্রকাশ্যে। ২০০১ সালে নির্বাচনের মাস দুই আগে আমাকে এক গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি কূটনীতিবিদ আগাম বার্তা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এবার আওয়ামী লীগ জিতবে না।’ তাঁর এই মন্তব্যের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় এসে সফল রাজনীতির জন্য যে সফল রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োজন, তা হয়তো বুঝতে পারেনি এবং তারা নিশ্চিতভাবে সব কিছু তাদের মতো করে হবে, তা ধরে নিয়েছে, যা আত্মঘাতী হতে পারে। সেই পরিচিতজন তাঁর পদ ও দায়িত্বের কারণে এর বাইরে কিছু বলতে চাননি। তিনি এখন নিজ দেশে অবসর জীবন যাপন করছেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে শুধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়নি, পরাজিত হয়েছিল বাংলাদেশের সুষ্ঠু রাজনীতি, যা এখনো অন্ধকার কানাগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই রাজনীতি দেশের রাজনীতির দুটি ধারাকে স্পষ্ট করেছিল। একটি ধারা মূলত আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল ধারা। অন্যটি ঠিক তার বিপরীত। এই বিপরীতে শুধু যে আওয়ামী লীগবিরোধীরা আছে তা নয়, তাদের সঙ্গে আছে দেশের একটি বিরাট শিক্ষিত নাগরিক সমাজ, এক শ্রেণির মিডিয়া আর বেশ কিছু বামপন্থী সংগঠন। তাদের এই ঐক্য কোনো আদর্শের ওপর ভিত্তি করে রচিত ছিল না। তারা একতাবদ্ধ হয়েছিল সব সময় সব কিছুর জন্য আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার জন্য। তাদের এই কাজে সহায়তা করেছিল আওয়ামী লীগের ভেতরে অনুপ্রবেশকারী কিছু নেতাকর্মী, যাঁদের অনেকেই বিভিন্ন পদ-পদবিতে দায়িত্বরত ছিলেন, কিন্তু লালন করতেন ভিন্ন মতাদর্শ।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় শুধু আওয়ামী লীগের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, ৩০ লাখ শহীদের রক্তবিধৌত স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যও অপরিহার্য ছিল। ২০০১-০৬ মেয়াদেও খালেদা জিয়ার সরকার এই দেশটিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদ চাষের অভয়ারণ্য করে তুলেছিল। একাত্তরের ঘাতকরা গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে বাংলাদেশ দাপিয়ে বেড়াত। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করার জন্য, অস্ত্র চোরাচালানের জন্য বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল একটি নিরাপদ রুট।
খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান এসবেরই নিয়ন্ত্রণকর্তা। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক না হলে তা হয়তো জনসমক্ষে আসত না। ভারতের অনেক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এই বিষয়গুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। বিএনপি ও তার মিত্ররা সব সময় শেখ হাসিনাকে দেখেছে তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। অতীতে তাঁকে হত্যা করার একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তাঁর ওপর চালানো গ্রেনেড হামলা, যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তারেক রহমান, যা দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণিত। সেই অপরাধে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে এখন লন্ডনে পলাতক।
খালেদা জিয়ার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে এলো এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সরকার। তারাও ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার কম চেষ্টা করেনি। সেই চেষ্টায় প্রকাশ্যে মদদ দিয়েছিল এ দেশেরই এক শ্রেণির শিক্ষিত নাগরিক সমাজ ও প্রতিষ্ঠিত কিছু মিডিয়া। তবে তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল দেশের ছাত্র-জনতার তীব্র গণ-আন্দোলনে। তারপর এলো ২০০৮ সালের নির্বাচন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয় আর পরের বছর জানুয়ারি মাসে সরকার গঠন। সেই থেকে শেখ হাসিনাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তিনি পর পর চারবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, যা একটি বিশ্বরেকর্ড।
আগের তিন মেয়াদে শেখ হাসিনা পাল্টে দিয়েছেন বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় স্বল্পোন্নত দেশের তকমাধারী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই দেশকে তিনি মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে তুলে এনেছেন এবং ২০২৬ সাল নাগাদ এই সম্মান পাওয়ার সব শর্ত পূরণ করা হয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এর পরের লক্ষ্য ২০৪১ সাল, যখন বাংলাদেশ একটি উন্নত বিশ্বের সদস্য হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দুই হাজার ৮০০ মার্কিন ডলারের মাথাপিছু আয় নিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৩৩তম অর্থনীতি। আশা করা যাচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ দখল করবে ২৪তম স্থান। গত তিন মেয়াদে শেষ হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ। যখন পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক এবং এ দেশেরই একটি মহল চালিয়েছিল নানা রকম ভয়াবহ ষড়যন্ত্র, তখন একজন শেখ হাসিনাই সংসদে দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছিলেন, ‘চাই না বিশ্বব্যংকের অর্থায়ন, আমরাই নিজের অর্থে করব এই সেতুর অর্থায়ন।’ সবাই বললেন শেখ হাসিনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন কন্যাটি বঙ্গবন্ধুর, যিনি বিশ্বের বড় বড় চোখরাঙানি উপেক্ষা করে বলতে পেরেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই তিন মেয়াদে বাংলাদেশ গেল মহাশূন্যে, দেশের মানুষ দেখল অনেক মেগাপ্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন। সার্বিক বিচারে শেখ হাসিনা এখন বিশ্বে বাংলাদেশের আরেক পতাকা ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। তিনি একজন প্রধানমন্ত্রীই নন, হয়ে উঠেছেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁর পথ আগলে ছিল বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের এ দেশীয় বেতনভুক তাঁবেদাররা। সব ভেস্তে গেল বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহস ও কৌশলের কাছে।
শেষে আসি ১০০ দিন প্রসঙ্গে। উল্লেখিত ১০০ দিন আরো ভালো যেতে পারত। বঙ্গবন্ধুর অনেক গুণের মধ্যে ছিল তিনি কোন কাজ কাকে দিয়ে হবে, তা বুঝতে পারতেন। কন্যা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। অনেক সময় পারেন না, তাঁকে ঘিরে থাকা অদৃশ্য দেয়াল সৃষ্টিকারী মানুষের কারণে। দেশের অর্থনীতি এখনো একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। তাঁরা সরকারের খুব কাছের মানুষ। দেশের ব্যাংকিং খাত যাঁদের হাতে, তাঁদের অনেকেই পরিচিত দুর্বৃত্ত। তাঁরা সব সময় ফুরফুরে মেজাজে থাকেন। ক্ষমতার অন্দরমহলে যাতায়াত অবারিত। সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সঠিক সাইজের চেয়ে বড় জুতা পরে হাঁটার চেষ্টা করে হোঁচট খাচ্ছেন। তাঁদের নিয়ে শেখ হাসিনা কত দূর যেতে পারবেন? তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা চিন্তিত। তবে দেশের মানুষ এখনো মনে করে, তাদের সব সমস্যার সমাধান, হোক না তা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি বা ঢাকা শহরের যানজট—শেখ হাসিনার কাছে আছে। মনে করে, তাঁর কাছে জাদু আছে।
আর কয়েক দিন পর আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বিগত সংসদ নির্বাচন ও আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, যা আগামী দিনে আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এটি শেখ হাসিনাই বুঝতে পারবেন যদি তিনি তাঁর চারপাশে থাকা অদৃশ্য দেয়ালটা ভেদ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারতেন, আমলাতন্ত্র কিভাবে দেশের সর্বনাশ করতে পারে। তাঁর কন্যা তা কতটুকু উপলব্ধি করেন, তা অনেকের প্রশ্ন। শেখ হাসিনাকে দেখতে হবে কারা কারা সাইজের বাইরে জুতা পায়ে দিয়েছেন। এই কাজগুলো করতে পারলে ডান, বাম, তামাদি বাম, স্বঘোষিত বাম, তাত্ত্বিক বাম, কুশিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক সমাজ শেখ হাসিনার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। ১০০ দিন নয়, সব দিনই এই সরকারের জন্য শুভ হোক।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক