বাংলাদেশের জন্মের আগে যে সংগঠনের জন্ম। যে সংগঠনের রয়েছে গৌরব উজ্জ্বল বর্ণিল ইতিহাস। বলা হয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। যদিও নানা কারণে বিভিন্ন সময় নেতিবাচক শিরোনামে এসেছে সংগঠনটির নাম। তবে এসব অপকর্মে জড়িতদের বেশির ভাগের নেপথ্যে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশকারীদের কারসাজির কথাও আলোচিত হয়েছে। বলা হয়, বিভিন্ন বিরোধী সংগঠন বিশেষ করে ইসলামি ছাত্র শিবির পরিকল্পিত ভাবেই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিজেদের প্রশিক্ষিত কর্মীদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।
আসন্ন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারা যে সাত জনের নাম প্রস্তাব করেছে তাদের মধ্যে অন্তত দুইজনের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতা ও বিবাহিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সর্বস্তরে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলার রাজনীতি প্রধানত মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ এই তিন সাংগঠনিক জেলা নিয়ে গঠিত। পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার সাথে সংযুক্ত চট্টগ্রামের দখিনা প্রবেশদ্বার অঞ্চলটি বরাবরই জামায়াত ও বিএনপি অধ্যুষিত। বিশেষ করে এক সময় লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও বাঁশখালী উপজেলাকে জামায়াতের দুর্গ কিংবা মিনি পাকিস্তান নামেও ডাকা হতো। এছাড়া চন্দনাইশ উপজেলাটি বিএনপি (পরে এলডিপি) শক্ত ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত। এমন স্পর্শকাতর অঞ্চলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কমিটির দুই শীর্ষ পদে শিবির সমর্থিত এমন কি বিবাহিত কাউকে বসানো হলে সংগঠনের ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যাবে বলে মনে করছে দীর্ঘদিন রাজপথে ছাত্রলীগের জন্য নিবেদিত নেতা কর্মীরা৷ যে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটির দুই শীর্ষ পদের জন্য দুইজন শিবির সমর্থিতর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে সেই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলাতেই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তিনজন সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্যের বসবাস। আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ও সরকারের অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াশিকা আয়েশা খান, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া দক্ষিণ চট্টগ্রামেরই সন্তান। এই তিনজন ছাড়াও এই অঞ্চলের রাজনীতিতে অভিভাবকত্ব করছেন শ্রম কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমপি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা বাংলাদেশ বুলেটিনকে জানিয়েছেন, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি সহসাই আসছে। ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং দক্ষিণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক করেছেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। কমিটির রূপরেখা নির্ধারণ করতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠকও করেছেন। এ সকল বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য সাতজনের নাম কেন্দ্রে প্রস্তাব করেছে আওয়ামী লীগ নেতারা।
নতুন কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য যে সাত জনের নাম কেন্দ্রে প্রস্তাব করা হয়েছে তারা হলেন, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সহসভাপতি সাতকানিয়ার জয়নাল আবেদিন, সাবেক সহসভাপতি সাতকানিয়ার ইয়াছিন চৌধুরী জনি, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চন্দনাইশের চৌধুরী তানভির, সাতকানিয়া উপজেলার ইরফান উদ্দীন, আনোয়ারা উপজেলার রবিউল হায়দার, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাশঁখালীর মামুনুর রহমান চৌধুরী এবং কর্ণফুলী উপজেলার ছাত্রলীগের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসাইন সাজিদ। এই সাত জনের মধ্যে একাধিক জনের বিরুদ্ধে জামায়াত কানেকশন ও বিতর্কিত নাম থাকায় আসন্ন কমিটিকে ঘরে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে অপ্রস্তাবিত নামের মধ্যে দুইজন কখনো কোন পর্যায়ে ছাত্রলীগের পদেই ছিলেন না বলে অভিযোগ তুলেছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। যারা কখনো ইউনিয়ন পর্যায়েও ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেয়নি তারা কিভাবে একটি সাংগঠনিক জেলার নেতৃত্ব দেবে এই প্রশ্নের সাথে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে বেশির ভাগ ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের মাঝে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দ্বায়িত্বশীল এক নেতা বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নাম প্রস্তাব করেছেন এটা সত্যি। তবে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাও যাচাই বাছাই করছি। ইতিমধ্যে এসব অভিযোগ ও অভিযোগের স্বপক্ষে বেশ কিছু ডকুমেন্ট কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতেও এসেছে। সুতরাং সেই সাতজন থেকেই যে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক আমরা নির্বাচন করবো সেটা এখনই নিশ্চিত হওয়ার কারণ নেই শেষ মুহূর্তে সাতজনের বাইরে থেকেও যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন করা থাকতে।
যাদের নিয়ে বিতর্ক ও অভিযোগ : প্রস্তাবিত সাত জনের একজন আনোয়ারা উপজেলার রবিউল হায়দারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হচ্ছে ইসলামি ছাত্র শিবিরের সাথে সম্পৃক্ততা। ইতিমধ্যে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র শিবিরের একটি সমর্থক ফরমে রবিউল হায়দারের নাম দেখা গেছে। যদিও ফরমটি ২০১২ সালের বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া শিবিরের প্যাড ও আয়ের রশিদেও রবিউলের ব্যক্তিগত তথ্য পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দক্ষিণ জেলার একাধিক ছাত্রলীগ নেতার মতে, রবিউল মাদ্রাসার পড়াকালীন সময় থেকেই ইসলামি ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। যদি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে রবিউল হায়দার জানিয়েছেন, “এসবই পুরোটাই মিথ্যা অপপ্রচার। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবেই এসব মিথ্যা ডকুমেন্ট ছড়ানো হচ্ছে। আমি দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতি করি। আমার উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি হয় না ১১ বছর তাহলে আমি পদ কোথাই পাবো?” আলোচনায় আসা সাতকানিয়া উপজেলার ইরফান উদ্দীনের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। পুলিশের অপরাধ তথ্য ভান্ডারে (পিসিপিআর) ইরফানকে ‘বিবাহিত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ইরফান উদ্দীনের বাবা রমজান আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা ও ডাকাতিসহ নানা অভিযোগ। তবে এ সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইরফান উদ্দিন। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক কিছু প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি এখনো একজন শিক্ষার্থী ও অবিবাহিত। আমার বিরুদ্ধে মামলা গুলো রাজনৈতিক।”
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির জন্য ইতোমধ্যে সাতজনের নাম পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, শিগগিরই কমিটি ঘোষণা হতে পারে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে সেগুলো আদৌ সত্য কিনা কেন্দ্রীয় কমিটি তদন্ত করছে।
আসন্ন দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি প্রসঙ্গে সদ্য বিলুপ্ত কমিটি সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, “আমি চাই যারা রাজপথে থেকে রাজনীতি করেছে এবং যাদের ইতিপূর্বে সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তাদেরকে যেন জেলা কমিটির নেতৃত্বে আনা হয়। কারণ একটি জেলার আওতা অনেক বড়। পূর্বের অভিজ্ঞতা না থাকলে এতো বড় দ্বায়িত্ব পালন সম্ভব না। সদ্য সাবেক সভাপতি এস এম বোরহান উদ্দিন বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, “আমরা কমিটি ছেড়ে আসার পর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে একটি কথাই বলেছি আমাদের কমিটিতেও অনেক ত্যাগী নেতা ছিল। এছাড়াও সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছে এমন নেতাও জেলা কমিটির নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা আছে। এসব নেতাদের যেন মূল্যায়ন করা হয়।” দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক এই দুই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, কোন ভাবেই শিবির বা অন্যকোনো সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত কাউকে শীর্ষ পদে তারাও দেখতে চান না।