আর্থনীতিক ও বাণিজ্যিক অগ্রগতি নিশ্চিতকরণে দুটি রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্মতিকে চুক্তি বলে। আরবি শব্দ ‘আকুদ’-এর অর্থ সন্ধি বা চুক্তি। চুক্তি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল কন্ট্রাক্ট। ইংরেজি কন্ট্রাক্ট শব্দটি ল্যাটিন শব্দ কন্ট্রাক্টাম থেকে এসেছে। এর আভিধানিক অর্থ একত্রিকরণ। চুক্তির মাধ্যমে আইনগত বন্ধনের সৃষ্টি হয়। যে কোন দুটি দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি একটি আপোষ প্রক্রিয়া।
গত ১৩ মে ভারত-ইরান চাবাহার বন্দর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেদিন থেকে চুক্তিটি বিশ্বব্যাপী আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণার অন্যতম একটি আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। চাবাহার বন্দর, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষাসহ ইরানের সঙ্গে এবার ৯টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত। গুরুত্ব পেয়েছে শক্তি, যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সহায়তার মতো বিষয়গুলি। ভিসানীতি সরলতর করতেও চুক্তি ভারত ও ইরান।
২০১৫ সালে চাবাহার বন্দর নিয়ে সহযোগিতার জন্য ভারত ও ইরানের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। পরে ২০১৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইরান সফরের সময় চুক্তিটি কার্যকর হয়েছিলো। বছর বছর ভারত-ইরান চুক্তি নবীকরণ করে ২০১৫ সাল থেকে চাবাহারের শহিদ বেহেস্তি বন্দর ব্যবহার করে আসছিলো ভারত। নতুন চুক্তির ফলে টানা ১০ বছর বন্দরের পরিচালনভার পেল ভারত।
মেয়াদপূর্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবীকরণ হবে এই চুক্তি। এই চুক্তি ভারতকে আফগানিস্তান, ইরান হয়ে রাশিয়া পর্যন্ত জলপথ পরিবহণে আধিপত্য বিস্তারের বৈধতা দিল। এই বন্দরকে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোরের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা আছে ভারতের। যাতে করে এই করিডোরের মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে সহজেই যুক্ত হতে পারবে ভারত। পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে আফগানিস্তান এবং পশ্চিম এশিয়ায় পৌঁছোতে ভারতের জন্য অন্যতম বিকল্প একটি পথ হিসেবে আবির্ভাব হলো চাবাহার বন্দরের। অপরদিকে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও চাবাহার সমুদ্রবন্দর ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাবাহারের নিকটতম বন্দর গুজরাটের কান্দালার দূরত্ব ৫৫০ নটিক্যাল মাইল। মুম্বইয়ের দূরত্ব ৭৮৬ নটিক্যাল মাইল। ভারত, পশ্চিম এশিয়া, ইউরেশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং পরিবহণ খরচ ও সময় কমানোর ক্ষেত্রে ভারতের প্রাণকেন্দ্র হতে যাচ্ছে এই সমুদ্রবন্দর।
তবে ভারত-ইরান চাবাহার চুক্তি আমেরিকার দৃষ্টিতে নেতিবাচক। ইরান, আমেরিকার মিত্রদেশ নয়। ইরানের কূটনীতি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাদরে মোড়ানো। সঙ্গত কারণেই ভারত-ইরান চাবাহার চুক্তি ভালোভাবে নিচ্ছে না আমেরিকা। এক্ষেত্রে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কাঠিণ্য ভারতে বিরাজ করতেই পারে। এরইমধ্যে সে ইঙ্গিত দিয়েছে আমেরিকা। ভারত-ইরান চুক্তি প্রসঙ্গে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপাল ডেপুটি মুখপাত্র বেদন্ত প্যাটেল হুঁশিয়ারির সুরে বলেন, ‘কেউ যদি ইরানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের কথা ভাবে, তা হলে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ ইরান ও আমেরিকার বৈরী সম্পর্ক স্পষ্টত দৃশ্যমান। বিভিন্ন ইস্যুতে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে হোয়াইট হাউস।
আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা জারি করার তালিকায় প্রথম রাশিয়া দ্বিতীয় ইরান। চাবাহার বন্দর চুক্তি নিয়ে বেদান্ত প্যাটেলের মন্তব্যের পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যপক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মতে চাবাহার বন্দর চুক্তি নিয়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি কেবল আমেরিকার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। অপরদিকে ইরানের রাষ্ট্রদূত ইরাজ ইলাহি মনে করেন চাবাহার বন্দর চুক্তির কারণে আমেরিকা ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে না। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, তাদের উপেক্ষা করতে পারবে না আমেরিকা।’
কোন দেশের প্রতি বিরাগভাজন হলে আমেরিকা সে দেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে, অস্ত্র-সম্পর্কিত রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা/সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য দ্বৈত প্রযুক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা/যেকোনো আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ/অর্থনৈতিক সহায়তার উপর সীমাবদ্ধতা ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা/জিএসপি সুবিধা বাতিলকরণ ইত্যাদি। কোন রাষ্ট্রই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে চায় না।
চাবাহার বন্দর চুক্তি কি ভারত-আমেরিকার সম্পর্কে ফাটল ধরাবে? ভারতের উপর কি সত্যিই নিষেধাজ্ঞা চাপাবে হোয়াইট হাউস নাকি কেবলই ফাঁকা বুলি? বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাওয়া এই চিন্তনের অবসান হবে কখন? ভারতীয় রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অধিকাংশই আমেরিকা প্রবাসী। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের মজবুত কূটনৈতিক সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক এতটুকুতেই ভেঙে যাওয়ার নয়। কেবল একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি কখনোই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রধান কারণ হতে পারে না। ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা ও দেশের মধ্যে সময়ের প্রয়োজনেই নানাবিধ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ইরানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শিকার হতে হবে কেন? তাছাড়া ভারত-ইরান পারস্পরিক সম্পর্ক নতুন নয়।
স্বাধীন ভারত এবং ইরান ১৯৫০ সালের ১৫ মার্চ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। প্রাচীন পারস্য এবং প্রাচীন ভারত উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক এক সহস্রাব্দের। ভারত ও ইরানের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বহুক্ষেত্রে দৃশ্যমান। দেশ দুটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ভারত ইরান থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে এবং ইরানে ডিজেল রপ্তানি করে।
সার্ক আঞ্চলিক সংস্থায় পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের অন্তর্ভুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত। ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ইরানি ছাত্র ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নথিভুক্ত হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে ভারত ও ইরান একযোগে তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে উওর জোটকে সমর্থন করেছিল। দেশ দুটি একত্রে ২০০২ সালের ডিসেম্বরে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভারত ২০১০ সালে ইরানের উপর আমেরিকান পুনঃনিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। তখন তো ভারতকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রদানের হুঁশিয়ারি দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ভারত-ইরান চাবাহার চুক্তি মার্কিন প্রশাসনের কাছে হঠাৎ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো? প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিশ্বসভ্যতার ঊষালগ্নে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা গোত্রের দলনেতারা সমঝোতার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হত। রাজার একক ক্ষমতা হ্রাস করতে ১২১৫ সালের ১৫ জুন রাজা জন ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন সামন্তদের মধ্যে ম্যাগনাকার্টা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য ১৭৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মধ্যে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আইবিআরডি ও আইএমএফ গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির জন্য ১৯৪৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নর্থ আটলান্টিক ট্রিট্রি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল উত্তর আটলান্টিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর রক্ষার্থে ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিল প্রোটোকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৬টি দেশের মধ্যে ভিসামুক্ত চলাচলের জন্য ১৯৮৫ সালের ১৪ জুন শেনজেন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এন্টি ব্যালাস্টিক মিসাইল সিস্টেম সীমিত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৬ মে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সল্ট-১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আক্রমণাত্মক অস্ত্রনিক্ষেপকারী ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্র আরও সীমত করতে ১৯৭৯ সালের ১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সল্ট-২ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণের জন্য ১৯৯১ সালেত ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্টার্ট-১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পারস্পরিক স্বীকৃতি দানের জন্য ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল ও পিএলও এর মধ্যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৪৬ বছর ধরে চলা যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটাতে ১৯৯৪ সালের ২৬ অক্টোবর জর্দান ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে বেসামরিক পরমাণু প্রযুক্তি সংগ্রহের জন্য ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করতে ১৯৯৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সমন্বিত পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে কোন পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপন না করা এবং শান্তিপূর্ণভাবে মহাকাশ অভিযানে সহযোগিতা করতে ১৯৬৭ সালের ২৭ জানুয়ারি মহাশূন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বিভিন্ন প্রয়োজনে দেশে দেশে চুক্তি অতীতেও হয়েছে এখনো হচ্ছে। কিন্তু ভারত-ইরান চাবাহার চুক্তির পরিনাম কি সত্যিই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা? মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় দেশের সংখ্যা এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে দেখা যাবে একসময় যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের সকল দেশের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকবে। পুরোপুরি একটি বন্ধুশূন্য দেশে পরিণত হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
লেখক : শিক্ষক ও সংগঠক