মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫ ৯ বৈশাখ ১৪৩২
মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫
জয়ী হওয়া সম্ভব, যদি যুদ্ধে থাকা যায়
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ১১:২১ AM
আমাদের সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য অত্যাবশ্যক সাংস্কৃতিক কাজটি বাংলাদেশে আমরা করছি কি? না, করছি না। যেমন ধরা যাক, পাঠাগার। পাঠাগারে গিয়ে তো মানুষ একত্র হতে পারে। বইকে কেন্দ্র করে মেলামেশা সম্ভব। কিন্তু মানুষ তো এখন আর বই পড়ায় আগ্রহী নয়, পড়লেও পাঠাগারে যায় না; ইন্টারনেট, ওয়েবসাইটে টেপাটেপি করে ঘরে বসে যান্ত্রিক বই সংগ্রহ করে নিয়ে কোনায় বসে বসে পড়ে। 

পাঠাগার কেবল বই সংগ্রহের জায়গা হলে সেখানে লোক পাওয়া কঠিন হবে; হচ্ছেও। পাঠাগারকে সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। পাঠাগার হবে সামাজিকভাবে মেলার একটি জায়গা, যেখানে মানুষ কেবল বই পড়ার জন্য যাবে না, নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আকর্ষণেও যাবে। পাঠাগার হওয়া চাই একটি আশ্রয়কেন্দ্র, যেখানে বই নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি নাটক, গান, আবৃত্তি, বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন, আলোচনা, বক্তৃতা, খেলাধুলা, শরীরচর্চা প্রতিযোগিতা, অনেক কিছুর আয়োজন করা সম্ভব। সেটা করা গেলে বিকাল হলেই মানুষ ওই আশ্রয়ের দিকে রওনা হবে। ছাত্র, কর্মচারী, শিক্ষক, অবসরভোগী, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী সবাই আসবে। মিলবে-মিশবে; সামাজিক হবে। আলোচনা করবে ব্যবস্থা পরিবর্তনের মতাদর্শ নিয়ে। সবকিছুর ভেতরই মতাদর্শিক বিবেচনাটা থাকবে, মিছরির ভেতর যেমন সুতো থাকত, যে সুতো ছাড়া মিছরি তৈরি করার কথা ভাবা যেত না।

দৃষ্টি দিতে হবে শিশু-কিশোরদের ওপর। খুবই জরুরি হচ্ছে একটি কিশোর আন্দোলন গড়ে তোলা। এক সময়ে কিশোর আন্দোলন ছিল; এখন নেই, পুঁজির শাসক সবগুলোকেই গ্রাস করে ফেলেছে। মুকুল ফৌজ গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান আন্দোলনের অনুপ্রেরণায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সে সংগঠন তার প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকে, এক সময়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। খেলাঘর যুক্ত ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে; কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিখণ্ডিত হওয়া এবং বিভিন্ন স্রোতে বিভক্ত হয়ে পড়ায় খেলাঘর এখন আর নেই বললেই চলে। কচিকাঁচার মেলা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারাতে গড়ে উঠেছিল। ওই ধারাও তার ভেতরকার উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেছে। কিশোরদের এখন কোনো সংগঠন নেই। তারা স্কুল ও কোচিং সেন্টারে ছোটাছুটি করে, ঘরে ফিরে ইন্টারনেট ও ফেসবুকের ওপর নুইয়ে থাকে, বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পায়; অনেকে মাদকাসক্ত হয়, জড়িয়ে পড়ে অপরাধে। কিশোরকে নিয়ে আসা চাই বড় অঙ্গনে। তার সৃষ্টিশীলতা ও দুঃসাহসকে উৎসাহিত করা অত্যাবশ্যক। সৃষ্টিশীলতা বাড়ে সামাজিকতায়; আর সবচেয়ে বড় দুঃসাহসিক কাজটা হলো সামাজিক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ। দেশব্যাপী একটি কিশোর আন্দোলন গড়ে তোলা আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

যুগ এখন মিডিয়ার। মিডিয়ার এত ক্ষমতা আগে কেউ কখনো দেখেনি। মিডিয়া পুরোপুরি পুঁজিবাদীদের দখলে। পুঁজিবাদের বড় একটা ভরসাও ওই মিডিয়ার ওপরই। বাংলাদেশে সমাজ-পরিবর্তনকামীদের হাতে মিডিয়া নেই। দৈনিক দূরের কথা, একটি সাপ্তাহিকও নেই। খুব দরকার অন্তত একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা চালু করার। সে পত্রিকা দেশ-বিদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে যা ঘটছে সেগুলো কেন ঘটছে, যা দৃশ্যমান তার পেছনে কোন স্বার্থের কারসাজি কাজ করছে, ঘটনাবলির তাৎপর্য কী, বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর যোগ কোথায় এবং উত্তরণ কোন পথে সম্ভব, এসব বিষয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে আলোচনা করবে। তাতে পাঠকের জ্ঞান যেমন বাড়বে, তেমনি সৃষ্টি হবে অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দীপনা। সমাজকে যারা বদলাতে চান তাদের পক্ষে সবাই মিলে অন্তত একটি সাপ্তাহিক প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া অত্যাবশ্যক। এটি হবে বড় একটি সাংস্কৃতিক পদক্ষেপ।

স্বাধীনতার পর মনে হয়েছিল দেশে একটি নাট্যান্দোলন শুরু হবে। শুরু হয়েছিল, কিন্তু এগোয়নি। শিল্পীরা চলে গেছেন টেলিভিশনে ও সিনেমায়। তেমন গান গাওয়া যায়নি যা মানুষকে একই সঙ্গে আনন্দ দেবে এবং উদ্দীপ্ত করবে। কবিতা লেখা হচ্ছে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা নিয়ে, তাতে দুঃখের দুর্বিষহতা যত পাওয়া যাচ্ছে, গভীর কোনো দার্শনিকতা তত পাওয়া যাচ্ছে না।

মোট কথা, বিদ্যমান অন্ধকারে মননশীলতা ও সৃজনশীলতার আলো জ্বালা চাই, যে আলো সম্ভব করবে সাংস্কৃতিক জাগরণের এবং পথ দেখাবে সামাজিক বিপ্লবের, যার মধ্য দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা বর্তমান পুঁজিবাদী স্তরে আর আটকে থাকবে না, বন্ধন ভেঙে সমাজতান্ত্রিক স্তরে উন্নীত হবে। জীবনে আসবে প্রাচুর্য, জীবনযাপন হবে আনন্দময়। সে কাজ একা কেউ করতে পারবে না, অল্প কজনে কুলাবে না; তার জন্য পাড়ায়-মহল্লায়, যেমন শহরে তেমনি গ্রামগঞ্জে, সব ধরনের বসতিতে সংস্কৃতিকেন্দ্র গড়ে তোলা চাই। ওইখানে পরিবর্তনকামী মানুষের সাংস্কৃতিক লালনপালন চলবে, মানুষ সোৎসাহে রাজনীতিতে যোগ দেবে। রাজনীতি বুর্জোয়াদের ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্রীড়া-কৌতুকে সীমিত থাকবে না, হয়ে দাঁড়াবে বিপ্লবীদের সমাজ পরিবর্তনের পদক্ষেপ।

পৃথিবীব্যাপী আজ পুঁজিবাদবিরোধী চেতনা প্রখর হয়ে উঠেছে; সেই চেতনাকে সামাজিক বিপ্লবের পথে এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর করার ওপরই কিন্তু নির্ভর করছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ।

মধ্যযুগের কবির একটা পরামর্শ ছিল- ‘এবার তোর ভরা আপন তুই বিলিয়ে দেরে যারে তারে।’ ওই পরামর্শে কিন্তু কুলাবে না। কেননা বিপদটা হবে এই যে, আমার আপন যদি আপনে ভরপুর হয়ে যায়, যদি ভারী হয়ে ওঠে স্বার্থে ও সম্পদলিপ্সায় তবে সে ‘আপন’ নির্ঘাৎ ডুববে এবং নিজে ডোবার আগে অন্যদের ভরাডুবি ঘটাতে চাইবে এবং তাতে করে সবারই হবে ডোবার দশা। সেটাই এখন ঘটছে, বিশ্বময়। আমার ‘আপন’ ভাসবে যদি নিজে ভারী না হয়ে অপরের সঙ্গে একত্রে ভাসতে চায় তবেই। মুশকিল যা ঘটানোর ঘটাবে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা। ঘটাচ্ছেও। মানুষের পক্ষে তাই মানুষ থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে, সামাজিকতা হারিয়ে সে অধম হয়ে পড়ছে বন্য প্রাণীরও।

ক্ষমতাধররা ও বচনবাগীশরা যা ইচ্ছা বলুন, বলতে থাকুন, আসল কথাটা হলো সমাজ পরিবর্তন। সেটা যেন না ভুলি। এটাও যেন না ভুলি যে পালানোর কোনো উপায় নেই, পালালেও বাঁচা যাবে না এবং বাঁচা মানে কেবল টিকে থাকা নয়, মানুষের মতো বাঁচা।

কিন্তু আমরা বাঁচব, অবশ্যই জয়ী হব, যদি আমরা যুদ্ধে থাকি। ভরসা এই যে, আমরা একা নই। বিশ্বজুড়ে মানুষ এখন যুদ্ধে আছে। প্রতিটি সমাজেই ব্যক্তিমানুষ যতই সন্ত্রস্ত হোক, ভয় পাক, সমষ্টিবদ্ধ মানুষ লড়ছে এবং লড়তে গিয়েই বুঝে নিচ্ছে যে বাঁচতে হলে লড়তে হবে। বাঁচার সঙ্গে মরার যে যুদ্ধ তাতে পরাজয়ের কোনো স্থান নেই। ইতিহাস এগোচ্ছে এবং এগোবেই। ইতিহাসে বাঁক আছে, কিন্তু থেমে যাওয়া নেই। ইতিহাসকে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রামে আমরা বাংলাদেশের মানুষরাও আছি। অতীতে ছিলাম, আছি বর্তমানে এবং থাকব ভবিষ্যতেও। তবে ইতিহাস এমনি এমনি এগোয় না; তার জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি চাই, অনুশীলন চাই জ্ঞানের ও সৃজনশীলতার। সবার ওপরে চাই সংঘবদ্ধতা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত