বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে৷ জেলা প্রশাসনের আশ্রয় কেন্দ্র ও স্কুলের পাশাপাশি চসিক তাদের নিয়ন্ত্রনাধীন স্কুল গুলোকে বন্ধ রেখে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরে থাকা জাহাজের পণ্য ওঠানামা-খালাস বন্ধ করা হয়েছে। রবিবার (২৬ মে) দুপুর ১২টা থেকে শাহ আমানত বিমান বন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা রাখা হয়েছে ৷ চিকিৎসা সেব নিশ্চিত করতে সিভিল সার্জনের উদ্যোগে প্রস্তুত করা হয়েছে তিনশতাধিক মেডিকেল টিম।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন : ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ৭৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও ১১৪০টি বিদ্যালয় ও নয়টি মুজিব কিল্লা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷ ইতিমধ্যে এই সংক্রান্ত জরুরি সভা করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। অনুষ্ঠিত বৈঠকে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়।
সভায় জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের উপকূলীয় সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, বাঁশখালী, মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও কর্ণফুলী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) বিশেষভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করার নির্দেশনা দেন।একই সাথে মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীর সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সবাইকে নির্দেশনা প্রদান করেন।
সভায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রামে ব্যাপক বর্ষণ ও পূর্ণিমার কারণে তীব্র জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা থাকায় উপকূলবর্তী এলাকা এবং পাহাড়ি এলাকা থেকে লোকজনকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন : ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে কোন প্রকার হতাহতের ঘটনা ঘটলে দ্রুততম সময় চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কর্তৃক ইউনিয়ন পর্যায়ে ২০০টি, প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫টি, আর্বান ডিসপেন্সারি ৯টি এবং ৫টি জেনারেল হাসপাতালসহ মোট ২৯৫টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য প্রায় তিন লাখ ট্যাবলেট ও চার লাখ খাবার স্যালাইন মজুত রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) : ঘুর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে জানমাল রক্ষার্থে নিজেদের ৮১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্রে হিসেবে ব্যবহার করবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।
রোববার (২৬ মে) টাইগারপাসের চসিক কার্যালয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে এক জরুরি প্রস্তুতি সভায় এ ঘোষণা দেন সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। চসিক মেয়র বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, "সোমবার চসিকের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে চসিকের ৮১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোকে আশ্রয়কেন্দ্রে হিসেবে ব্যবহার করা হবে।" ইতিমধ্যে দামপাড়াস্থ চসিকের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগস্থ কার্যালয়ে চসিকের নিজস্ব কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে বলে জানান চসিক মেয়র।
চসিকের ৪১টি ওয়ার্ডে বৃষ্টির পানি যাতে নালায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না করতে পারে সেজন্য ছোট ছোট টিম গঠন করে পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চলছে৷ কন্ট্রোল রুমের সাথে সমন্বয় করে ৩ শিফটে ৩টি মেডিক্যাল টিম ২৪ ঘন্টা সক্রিয় রাখা হয়েছে৷ এছাড়া, ৬টি উপকূলীয় ও পাহাড়সমৃদ্ধ এলাকার জন্য গঠন করা হয়েছে স্পেশাল টিম।
চট্টগ্রাম বন্দর : চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙরে থাকা জাহাজের পণ্য ওঠানামা-খালাস বন্ধ করা হয়েছে। তবে যেসব জাহাজে পণ্য ওঠানামা অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় আছে, সেসব জাহাজে দ্রুত কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। রবিবার (২৬ মে) সকাল থেকে বন্দর চ্যানেল, জাহাজ, জেটি, ইয়ার্ড, শেড, হ্যান্ডলিং ইকু্ইপমেন্ট নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বন্দরের বহির্নোঙরে থাকা সব লাইটার জাহাজ কর্ণফুলী নদীর উজানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, ‘আবহাওয়া অফিস সিগন্যাল-৯ জারির পর আমরা চট্টগ্রাম বন্দরে অ্যালার্ট-৪ জারি করেছি। সাধারণত সংকেত ৬ কিংবা এর উপরে গেলে আমরা বন্দরে বিপদ সংকেত জারি করি।’ ওমর ফারুক আরো বলেন, ‘বহির্নোঙর থেকেও সব মাদার ভ্যাসেল গভীর সমুদ্রে পাঠানো হচ্ছে। আমরা এখন বন্দরের ইক্যুইপমেন্টগুলো সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি। জাহাজ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু টানেল : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে জলোচ্ছ্বাসের আশংকায় চট্টগ্রাম কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। রবিবার (২৬ মে) সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে টানেল বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের টোল ম্যানেজার বেলায়েত হোসেন বাংলাদেশ বুলেটিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন৷ তিনি জানান, রবিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে বন্ধ থাকবে। আবহাওয়া অধিদফতরের পরবর্তী পূর্বাভাস জেনে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই টানেলে যান চলাচল চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম বিমান বন্দর : ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান উঠানামা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলার পর আজ রবিবার (২৬ মে) দুপুর ১২টা থেকে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রাথমিকভাবে দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিমান ওঠানামা বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তসলিম আহমেদ বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, "ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কমাতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিয়েছে। আমাদের এই বিমানবন্দরটির সম্পদ এবং জনশক্তির নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ সজাগ রয়েছে।"