দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। শিক্ষার বিস্তার এবং যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে তাই শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হয়। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। এটা সময়ের দাবি। শিক্ষাব্যবস্থা একটি পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়িত হচ্ছে। পুরোপুরি বাস্তবায়নে আরও সময় প্রয়োজন। প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষ শিক্ষক। না হলে শিক্ষা পিছিয়ে পড়বে।
শিক্ষা পিছিয়ে পরলে দেশও পিছিয়ে পরবে। যে উন্নয়ন দৃশ্যমান নয় এবং স্থায়ী সেটি হলো শিক্ষা। তাই এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। মুখস্থ নির্ভর বিদ্যায় শিক্ষা পিছিয়ে পরেছে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শাখায় প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখনও বহু শিক্ষকের পদ শূণ্য হয়েছে। শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন অবকাঠামো প্রয়োজন রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আরেকটি বাজেট ঘোষিত আসছে। এবারের বাজেট গতবারের থেকেও চ্যালেঞ্জিং। আমাদের ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌছানোর লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছি। সেই লক্ষ্যে শিক্ষাকেও উন্নত বিশ্বের কাতারে দাঁড় করাতে হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে- দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয়ের জন্য ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে পরামর্শ থাকলেও সর্বশেষ বাজেটে এ বরাদ্দ হয় জিডিপির মাত্র ১.৭৬ শতাংশ। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষায় জিডিপির ৫ শতাংশ বা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের আশ্বাস থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে তাই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি নতুন করে উচ্চারিত হচ্ছে। সূত্রমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল ৮৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, যেখানে টাকার অঙ্ক বাড়লেও জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হয় গত অর্থবছরে জিডিপির মাত্র ১.৭৬ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১.৮৩ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২.০৮ শতাংশ, যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষাখাতে ৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকার কথা।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ, কঙ্গো ও উগান্ডা ২ দশমিক ২ শতাংশ, চাদ ২ দশমিক ৫ শতাংশ, কম্বোডিয়া ২ দশমিক ৬ শতাংশ, রুয়ান্ডা ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, সেনেগাল ও ইথিওপিয়া ৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং সিয়েরা লিওন ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যয় করে শিক্ষাখাতে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জিডিপির শতাংশ হিসেবে বাংলাদেশের গড় শিক্ষাব্যয় আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে কম। তথ্যে আরো দেখা যায়, ভুটান ২০২১ সালে জিডিপির ৭ শতাংশ, ভারত ২০২০ সালে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, পাকিস্তান ২০২১ সালে ২ দশমিক ৪ শতাংশ, মালদ্বীপ ২০২০ সালে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ, নেপাল ২০২০ সালে ৪ দশমিক ২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২০১৯ সালে ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং আফগানিস্তান ২০১৯ সালে ২ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যয় করেছে শিক্ষা খাতে।
বাজেট একটি দেশের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক। বাজেট প্রণয়ন নয় বরং বাজেট বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ হয় সরকারের জন্য। প্রান্তিক জনসাধারণের কাছে বাজেটের সুফল পৌঁছানো এবং দেশকে গতিশীল অভিমুখে ধাবিত করাই বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য থাকে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই বাজেট ঘোষিত হয়। বাজেট ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই মিডিয়াসহ সর্বত্র বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়। আসছে বাজেট কেমন হবে এবং বিগত বাজেট কেমন ছিল বা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়েই এসব আলোচনা চলে।
বাজেটে নির্ধারিত খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কারিগরী শিক্ষা এগিয়ে নিতে হবে। কারণ দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে কারিগরি শিক্ষা প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই সাথে সাধারণ শিক্ষার গুণগত মানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এবং এর সাথেই গবেষণায় ব্যাপক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দেশে গবেষণার দিক অত্যন্ত দুর্বল। শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্যে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
২০২০-২১ সালের অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা,মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদরাসা খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এ খাতে আরও বেশি বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। কারণ টেকসই শিক্ষা অর্জন করতে হলে শিক্ষার মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ খাতকে সর্বাগ্রে এগিয়ে নিতে হবে।
শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার গুণগত উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করা, শিক্ষা উপকরণ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ খাতকে গুরুত্বপূর্ণ বলছি এ কারণে যে শিক্ষার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হয় না বলেই আমার মনে হয়। যতদিন শিক্ষাকে যুগোপযোগী এবং আন্তর্জাতিকমানের করা না যাবে ততদিন দেশ কাঙ্খিত সাফল্য পাবে না। ফলে এ খাতে বেশি গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই উন্নত করতে হবে। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাখাতে যে চাহিদাগুলো রয়েছে সেগুলো পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি দীর্ঘদিনের। তাছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসবভাতার দাবিও রয়েছে। সুতরাং এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো দরকার। সবচেয়ে ভালো হয় শিক্ষকদের জন্য একটি পৃথক বেতনকাঠামো প্রয়োজন। সেটি সম্ভব না হলেও পাশ্ববর্তী অন্যান্য দেশগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বেতনকাঠামো বাস্তবায়ন দরকার। কারণ শিক্ষক যদি পেটের চিন্তায় থাকে তাহলে তাকে দিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন অসম্ভব। আর শিক্ষা বাস্তবায়ন যদি অসম্পূর্ণ থেকে যায় সেটি জাতির জন্য সুখকর হবে না। সবচেয়ে বড় সম্পদ শিক্ষা। কারণ এই একটা খাত আরও অনেক খাতকে শক্তিশালী করতে পারে। আমরাও আশা করি এই খাতটি আরও বেশি বরাদ্দ পাক। শিক্ষা এবং প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে শিক্ষাখাতে আরও বেশি বরাদ্দ প্রত্যাশা করি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের শিক্ষা এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা। শিক্ষাখাতে বড় ধরনের বরাদ্দ প্রত্যাশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পাশর্বর্তী বিভিন্ন দেশ যেভাবে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে সেভাবে আমাদেরও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। সেজন্য বাজেটের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বরাদ্দর দাবিও উঠেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং জিডিপি’র ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২০-২১ সালে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ২ দশমিক ০৯ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বেড়েছিল ঠিক কিন্তু জিডিপি’র হিসেবে খুব বেশি নয়। সুতরাং সবমিলিয়ে এবছর সকলের প্রত্যাশা যে এই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের যে হাওয়া লেগেছে তা এগিয়ে যাবে সাবলীলভাবে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক