মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫ ৯ বৈশাখ ১৪৩২
মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫
পুতিন ও কিম : বন্ধুত্বের পেছনে রয়েছে চীন
প্রদীপ সাহা
প্রকাশ: সোমবার, ২৪ জুন, ২০২৪, ১১:৩৫ AM
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সম্প্রতি (১৯ জুন ২০২৪) পিয়ংইয়ং সফরে এসে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। সেখানে তাদের দু’দেশের বিরুদ্ধে যেকোনো আগ্রাসনে তারা পরস্পরকে সহায়তা করেন। মি. কিম বলেছেন, এটি তাদের স¤পর্ককে একটি নতুন ও সহযোগিতার অনন্য মাত্রা দিয়েছে। ২০০০ সালের পর প্রথমবারের মতো মি. পুতিনের পিয়ংইয়ং সফর ছিল রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে একটি বন্ধুত্বের প্রদর্শনীর সুযোগ। 

মি. কিমের ইউক্রেন আগ্রাসনে রাশিয়ার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণার মধ্য দিয়ে তারা সেটাই করেছেন। এর মধ্যে সিউল, টোকিও, ওয়াশিংটন এবং ব্রাসেলস গভীর বিপদ খুঁজে পাবে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, দুই নেতাই অনুভব করেছেন যে তাদের পরস্পর পর¯পরকে প্রয়োজন। মি. পুতিনের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য গোলাবারুদ দরকার, আর নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা উত্তর কোরিয়ার দরকার অর্থ। যদিও ওই অঞ্চলের প্রকৃত শক্তি পিয়ংইয়ং নয়। রাশিয়া আর উত্তর কোরিয়া- দুই দেশের নতুন করে যে বন্ধনের সূত্রপাত, তা কৌশলগত কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি বেইজিংর জন্য যাতে উস্কানি না হয়, সেই আশঙ্কা নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়েছে দুই দেশকে। বেইজিং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় থাকা উভয় দেশের জন্য বাণিজ্য ও প্রভাবের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যদিও মি. পুতিন বন্ধুত্বের জন্য মি. কিমের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তিনি অবশ্যই জানেন, তারও একটা সীমা আছে। আর সেই সীমাটা হলো চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

মি. শি জিনপিং তার দুই সহযোগী দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সখ্যতায় খুব একটা সন্তুষ্ট নন। বেইজিং পি. পুতিনকে গত মে ২০২৪ প্রেসিডেন্ট শি’র সঙ্গে বৈঠকের পর পিয়ংইয়ং সফরে না যেতে বলেছিল। মনে হচ্ছে চীনের কর্মকর্তারা সেই সফরে উত্তর কোরিয়াকে টেনে আনাটা পছন্দ করেননি। মি. শি জিনপিং মস্কোকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা হয় এমন কিছু বিক্রি না করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চাপের মধ্যে আছেন। তিনি এসব সতর্কতা পুরোপুরি উপেক্ষাও করতে পারেন না। বরং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য বেইজিংয়ের বিদেশি পর্যটক এবং বিনিয়োগ দরকার। 

দেশটি এখন ইউরোপের একাংশ, থাইল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার জন্য ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধা দিচ্ছে। দেশটির পাণ্ডা আবার বিদেশের চিড়িয়াখানায় ছাড়া হচ্ছে। চীনের উচ্চভিলাষী নেতা বৈশ্বিক পর্যায়ে আরও বড় ভূমিকা রাখতে চান এবং যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে চান। তিনি আর নতুন করে পশ্চিমা চাপ চান না। একই সঙ্গে তিনি মস্কোর সঙ্গেও স¤পর্ক বজায় রাখতে চান। তিনি ইউক্রেনে আগ্রাসনের নিন্দা করেননি, কিন্তু রাশিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সামরিক সহায়তা দিতে পারেননি। সম্ভবত পারমাণবিক অস্ত্র এগিয়ে নিতে মি. কিমের চেষ্টাকে চীন বারবার জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব ঠেকিয়ে একটি রাজনৈতিক সুরক্ষা দিচ্ছে।  

পিয়ংইয়ংয়ের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে নিজেদের তিক্ততাকে একপাশে ঠেলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে নিয়ে এসেছে। উত্তেজনা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ দেখা যায় প্রশান্ত মহাসাগরে, যা ইস্ট এশিয়ান ন্যাটো বিষয়ে মি. শি জিনপিংয়ের ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে। বেইজিংয়ে অননুমোদন হয়তো উত্তর কোরিয়ায় রাশিয়ান সামরিক প্রযুক্তির বিক্রি বাড়িয়ে দিতে পারে। সেটাও যুক্তরাষ্ট্রের বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে। রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে বিশাল পরিমাণে কোনো সামরিক প্রযুক্তি দেবে বলে মনে হয় না। আর সেটি করলে রাশিয়ার জন্য ভবিষ্যতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

যদিও উত্তর কোরিয়ার গোলাবারুদ মি. পুতিনের যুদ্ধপ্রচেষ্টাকে সহায়তা করবে। তবে এর জন্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির বিনিময় ভালো চুক্তি হবে না। এছাড়া মি. পুতিন হয়তো উপলব্ধি করবেন যে, চীনকে বিরক্ত করার জন্য এটা যথেষ্ট নয়। দেশটি রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস কিনছে। পিয়ংইয়ংয়ের চীনকে দরকার আরও বেশি। উত্তর কোরিয়ার এক-চতুর্থাংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত তেল আসে রাশিয়া থেকে, কিন্তু ৮০ ভাগ ব্যবসাই চলে চীনের সঙ্গে। মি. পুতিন এবং মি. কিম নিজেদের সহযোগী হিসেবে দেখালেও চীনের সঙ্গে তাদের স¤পর্ক আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ- এ কথা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়।

রাজনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা সত্ত্বেও এটি একটি যুদ্ধকালীন অংশীদারিত্ব। এটি আরও অগ্রসর হতে পারে। দুই দেশের মধ্যে সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি সত্ত্বেও পিয়ংইয়ং গোলাবারুদ সরবরাহ অব্যাহত রাখবে এমন নিশ্চয়তা নেই। বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া ভিন্ন ধরণের অপারেটিং সিস্টেমে কাজ করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, দেশ দুটি কয়েক দশক ধরে তাদের স¤পর্ককে অগ্রাধিকার দেয়নি। যখন পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল, তখন মি. পুতিন দু’বার পিয়ংইয়ংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন।

উত্তর কোরিয়া যাতে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলেন। মি. কিম যখন ২০১৮ সালের কূটনৈতিকভাবে প্রবল চাপের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তখন তিনি একবার ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারপর মি. কিমের চওড়া হাসি, আলিঙ্গন ও হাত মেলানোই ছিল দক্ষিণ কোরিয়া প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজ। তারা তিনবার পর¯পরের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি কথিত ‘প্রেমপত্র’ বিনিময় করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে; পরে তাদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। অন্যদিকে, মি. শি জিনপিং ছিলেন তার জন্য প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক নেতা, যার সঙ্গে তিনি তিনবার বৈঠক করেন। সুতরাং বন্ধু তালিকায় মি. পুতিন হচ্ছেন নতুন।  

উত্তর কোরিয়ার সংবাদপত্রে রাশিয়ার নেতা যে কলাম লিখেছেন, সেখানে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বার্থের কথা বলেছেন। তবে সেখানে মি. শি জিনপিংয়ের বিষয়টি আসেনি। তিনি নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে অপেক্ষা রাখার সাহস দেখাবেন না, যেমনটি পিয়ংইয়ং-এ হয়েছে। তারা দু’জনই চীনের সাহায্যপ্রার্থী এবং চীনকে ছাড়া তাদের শাসন সংকটে পড়বে। ফলে উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক বিষয়ে চীনের ভূমিকা থাকবেই।   

লেখক : কবি

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত