বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ১০ বৈশাখ ১৪৩২
বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় পিছিয়ে
ড. মাসুদ কামাল
প্রকাশ: রবিবার, ৩০ জুন, ২০২৪, ২:৪৯ PM আপডেট: ৩০.০৬.২০২৪ ৩:০৭ PM
উচ্চশিক্ষা অস্থিরতা বিরাজ করছে বাংলাদেশে। উচ্চশিক্ষা বলতে গবেষণানির্ভর বিশেষায়িত ডিগ্রি যেমন এমফিল ও পিএইচডিকে বোঝাচ্ছি। উচ্চশিক্ষার মূল কেন্দ্রস্থল মনে করা হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোর এ ধরনের ডিগ্রি প্রদানের অনুমোদন এখন পর্যন্ত নেই। 

বলা বাহুল্য, উচ্চশিক্ষার জন্য সম্প্রতি এক ধরনের তাড়না বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে গবেষণা করার উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। স্পষ্টতই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা প্রদানের জন্য প্রস্তুত নয়। কিন্তু কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ অবস্থা তা আমাদের জানা দরকার।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চশিক্ষার কাঠামো বেশ সমৃদ্ধ। এমফিল বা পিএইচডি প্রদানের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া। বাহ্যিকভাবে দেখলে প্রক্রিয়াটির বিশ্বের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রয়েছে। এ ব্যবস্থায় একজন গবেষককে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাত্ত্বিক ও গবেষণা পদ্ধতির ওপর কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। তারপর এক বা একাধিক সিনিয়র শিক্ষক তথা সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে মৌলিক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে থিসিস লিখতে হয়। শিক্ষার্থী গবেষকরা সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা ইনস্টিটিউশনে সেমিনারের মাধ্যমে তাদের কাজের অগ্রগতি উপস্থাপন করেন। থিসিস সম্পন্নের পর সিনিয়র অধ্যাপকরা সে গবেষণার মূল্যায়ন করে ডিগ্রি প্রদানের বিষয়ে মত দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পর্কিত সর্বোচ্চ পরিষদের (যেমন একাডেমিক কাউন্সিল) অনুমোদনের পর সে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বাহ্যিকভাবে দেখলে ব্যবস্থাটি চমৎকার। কিন্তু দেশ এ ব্যবস্থায় ভালো গবেষক তৈরি করতে পারছে না। তাহলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থাটির মধ্যে গলদ রয়েছে।

উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মূল কান্ডারি হলেন ভালো মানের গবেষকরা, যারা নিজেদের আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাই মূলত প্রতিষ্ঠিত গবেষক। গবেষণায় নিবেদিতপ্রাণ অধ্যাপকরাই নবীন গবেষক তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করবেন। আর তাদের গবেষণায় নিয়োজিত থাকা নির্ভর করে তারা গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনা পাচ্ছেন কি না তার ওপর। রাষ্ট্রই মূলত সে প্রণোদনার ব্যবস্থা করে থাকে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় এর ঘাটতি রয়েছে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দূরে থাক, তারা যে বেতন পান তা-ই অপ্রতুল। অনেককেই জীবনযাপনের খরচ মেটাতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, কনসালট্যান্সি বা প্রশাসনিক দায়দায়িত্বে ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়। যার ফলে বিদেশ থেকে অর্জিত গবেষণার প্রশিক্ষণটি অব্যবহৃত থেকে যায়, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চশিক্ষার দুর্বলতার আরেকটি অন্যতম কারণ যারা উচ্চতর ডিগ্রি করবেন তাদের জন্য পর্যাপ্ত ফেলোশিপ বা বৃত্তি না থাকা। ইউেরাপ-আমেরিকার কথা বাদই দিলাম, পাশের দেশ ভারতেই পিএইচডির জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার পর্যাপ্ত ফেলোশিপ প্রদান করে থাকে। যারা উচ্চতর গবেষণা ডিগ্রি করতে আসেন তাদের বয়স স্বাভাবিকভাবেই পঁচিশোর্ধ্ব। এ বয়সে একজন ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব নিতে হয়। 

যদি একজন শিক্ষানবিশ গবেষককে এর জন্য একটি ভালো মানের স্কলারশিপ না দেওয়া হয় তাহলে তাকে জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহের জন্য চাকরি বা অন্যান্য কাজ করতে হয়। সুতরাং গবেষণার জন্য তাদের যে পরিমাণ সময় ও মনোযোগ দেওয়া দরকার তারা তা দিতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় কিছু প্রতিষ্ঠান পিএইচডির স্কলারশিপ প্রদান করে; কিন্তু সেগুলো সংখ্যায় যৎসামান্য। আমার জানা মতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চশিক্ষার জন্য পূর্ণাঙ্গ স্কলারশিপ প্রায় নেই বললেই চলে। এজন্য প্রায়ই দেখা যায়, গবেষক শিক্ষার্থীদের কোনো চাকরি না করার বিধান থাকলেও কেউ মানছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও এ বিষয়ে উদাসীন দেখা যায়।

রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার পরিবেশ তৈরিতে অনীহা লক্ষ করা যায়। বরং ফেলোশিপ বা বৃত্তি দিয়ে গবেষকদের দেশের বাইরের উচ্চ মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে আগ্রহ দেখা যায়। এ প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার পরিবেশ তৈরিতে একদিকে যেমন নিরুৎসাহ করে, আবার তা দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে। 

বিশ্ববিদ্যায়গুলোয় ভালো মানের গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে পারলে জনসম্পদ উন্নয়নের প্রশিক্ষণ বা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে, শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যায়গুলো বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থী গবেষকদের আকৃষ্ট করে আর্থিকভাবে দেশকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। 

সাম্প্রতিককালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে অংশগ্রহণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব র‌্যাংকিংয়ে ভালো করার প্রধান উপায় হলো ভালো মানের গবেষণা ও তা প্রকাশ করা। তাই উচ্চশিক্ষার পরিসর বৃদ্ধি ও মান বাড়ানো ছাড়া বিশ্ববিদ্যালগুলোর সামনে এগোনোর আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। আশার দিক হলো দুয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তা উপলব্ধি করে গবেষণার পরিবেশ তৈরির কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলের ছাত্রদের মধ্যে গবেষণার উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। তার ফলস্বরূপ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত সংগঠন গড়ে উঠেছে ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্বে। এ সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ধরে নিয়েছে যে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ও গবেষণার মান নিম্ন এবং গবেষণা সম্পর্কিত পেশার সংখ্যা অপ্রতুল। অর্থাৎ গবেষণা করে আমাদের দেশে কিছু হবে না। তাই তাদের ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে। তাই তারা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার পর উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়তে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রস্তুতি বিষয়ে সভা-সেমিনার এবং অনলাইনে তথ্য আদানপ্রদান করে। এদের মধ্যে অনেকেই ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাচ্ছ। গবেষণায় আগ্রহী এ তরুণদের আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ করে দিলে তাদের মেধা কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশ সমৃদ্ধ করা সম্ভব হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো মানের গবেষণার পরিবেশ তৈরির বিকল্প নেই। যতক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্ঞান উৎপাদনের পরিবেশ তৈরি না হবে তত দিন আমাদের তথাকথিত পশ্চিমা বা উন্নত বিশ্বের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। জনসম্পদ তৈরির জন্য বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েও আমরা তার যথাযথ সুফল পাব না। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য অর্থাৎ জ্ঞান তৈরি ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে আমরা ব্যর্থ হব। এ দৈন্য ঘোচানোর জন্য আমাদের উচ্চশিক্ষা ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। আর সেজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা নীতিমালার সংস্কার এবং এর যথাযথ প্রয়োগ।

 লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত