নগরীর যানজট কমাতে বেশ ধুমধাম করে স্মার্ট পে পার্কিং নামে একটি আধুনিক পার্কিং ব্যবস্থা চালুর দাবি করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তবে এই গাড়ি গুলো পার্কিং করা হচ্ছে সড়কের ওপরেই। নগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার ভেতরের সড়ক গুলোর দুই পাশ বহু বছর ধরেই অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করা হতো৷ ফলে এসব সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হয়৷ আগে বিনামূল্যে সড়কের দুই পাশে গাড়ি পার্ক করে রাখা হতো, এখন অর্থের বিনিময়ে সেসব অবৈধ পার্কিং এর বৈধতা দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন৷ আগে সড়ক ইজারা দিলে লাইন ম্যান স্লিপ দিয়ে টাকা তুলতো৷ এখন স্মার্ট পে পার্কিং সেই টাকা ডিজিটাল ভাবে তুলবে। এভাবে সড়ককে সংকুচিত করে গাড়ি পার্কিং এর পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তো বলেই দিলেন, "গাড়ি তো রাস্তাতেই পার্কিং হবে।"
গত ৩০ জুন চট্টগ্রাম নগরীতে প্রথমবারের মতো পে-পার্কিং চালু করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। নগরের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় ‘ইয়েস পার্কিং’ অ্যাপসের মাধ্যমে স্মার্ট পে-পার্কিং সুবিধা পাবেন নগরবাসী এমন ঘোষণা দেন চসিক মেয়র। তবে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার সিলভার স্পুনের সামনের সড়ক থেকে কমার্স কলেজ পর্যন্ত এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, কপার চিমনি রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন সড়কে মোট ১৭৭টি গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যমান অবৈধ পার্কিং গুলোকে কিছু অর্থের বিনিময়ে বৈধতা দেয়া হয়েছে৷ সড়ক সংকুচিত করে যানজট কীভাবে কমবে এই প্রশ্নে আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দারা বলেন, রাস্তার পাশের বড় বড় বিল্ডিং গুলো নিজেদের পার্কিং স্পেস বাণিজ্যিক ভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে রেখেছে৷ ফলে সেখানে আগত গাড়ি গুলো সবসময় এই রাস্তার ওপরই পার্কিং করে রাখে৷ আগে মাগনা রাখতো এখন টাকা দিয়ে গাড়ি পার্কিং করবে৷ চসিক যদি নতুন কোন খোলা জায়গাকে পার্কিং এরিয়া বানিয়ে এসব গাড়িকে সেখানে পার্ক করাতো তাহলে এই এলাকায় যানজট মুক্ত হতো৷ এখন অবৈধ পার্কিং বৈধতা পাওয়ায় এলাকার এই যানজট স্থায়ী রূপ পেলো।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, পে-পার্কিংয়ের কার্যক্রমটি পরিচালনা করবে বি-ট্র্যাক সলিউশনস লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ইয়েস পার্কিং নামের এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ২০০টি গাড়ি রাখার জায়গা মিলবে। যারা এই ইয়েস পার্কিংয়ে তিন চাকা ও চার চাকার গাড়ি রাখবেন তাদের ঘণ্টাপ্রতি গুনতে হবে মাত্র ৩০ টাকা। এসব গাড়ি সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাখতে চাইলে দিতে হবে ২০০ টাকা। আর দুই চাকার গাড়ি অর্থাৎ মোটরসাইকেল বা স্কুটি রাখতে হলে ঘণ্টায় গুনতে হবে ১৫ টাকা। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাখতে হলে দিতে হবে ১০০ টাকা।
বিদ্যমান সড়কের দুই পাশে গাড়ি রেখে সড়ক সংকুচিত করে গাড়ি রাখা কতটুকু যৌক্তিক এই প্রশ্নের জবাবে চসিক এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চসিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, "গাড়ি তো রাস্তাতেই পার্ক করবে৷"
চসিক এর প্রধান প্রকৌশলী শাহীন-উল-ইসলাম চৌধুরি বলেন, "এই বিষয়টি নিয়ে চসিক প্রায় বছর খানেক সময় ধরে স্টাডি করেছে৷ আমাদের পরিকল্পনার সাথে ইয়েস পার্কিং এর মতের মিল হওয়ায় বিষয়টি পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু করা হয়েছে৷" এই সড়কের আগেও দুই পাশে গাড়ি পার্কিং করে রাখা হতো, এখনো হচ্ছে, এর ফলে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে যানজট লেগেই আছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "যদি যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে সেক্ষেত্রে আমরা সড়কের দুই পাশে পরিবর্তে একপাশে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করবো৷" পরিকল্পিত ভাবে নতুন পার্কিং জোন তৈরি না করে সারা শহরের সড়কের পাশে গাড়ি পার্কিং করলে বিদ্যমান সড়ক সংকুচিত হবে, সেক্ষেত্রে যানজট কীভাবে কমবে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "বিষয়টি এখন পাইলট প্রকল্প হিসেবে রয়েছে৷ আর স্থায়ী পার্কিং গড়ে তোলাটা সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার৷ আপাতত এভাবে কিছুদিন চলার পর বিষয়টি আবারো বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা হবে৷"
জানা গেছে, পার্কিং পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, পাইলট প্রকল্পের মেয়াদ হবে ছয় মাস। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের কার্যকারিতার পরিপ্রেক্ষিতে আরো আরো ছয় মাসের জন্য সময় বৃদ্ধির পরিকল্পনাও রয়েছে চসিক'র৷ চুক্তি অনুসারে, পে-পার্কিং থেকে মোট আয়ের ৩৫ শতাংশ পাবে চসিক। অর্জিত আয়ের হিসাব চসিক ও বি-ট্র্যাক সলিউশনস লিমিটেড গঠিত আর্থিক পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে। তবে পাইলট প্রকল্প হওয়ায় এখনো পর্যন্ত মোট আয়ের কত শতাংশ চসিক পাবে তা চূড়ান্ত হয়নি বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বি-ট্রেক সলিউশনসের প্রকল্প প্রধান সাফায়েত আবদুল্লাহ। যদিও চসিকের ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই পে-পার্কিং থেকে ৫০ লাখ টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনগুলো অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী পার্কিং স্পেস রাখছে না৷ আগে ও বর্তমান সময়ে নির্মিত বেশীর ভাগ ভবনের পার্কিং এরিয়াকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এই বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার পথেই হাঁটছে৷ অভিযোগ আছে সিডিএ'র অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণ এখন অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে৷ ১/১১ এর সময় নগরীর জিইসি সহ বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে অভিযান চালিয়ে পার্কিং স্পেস থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিক৷ এরপর সড়কের পাশে নির্মিত বেশিরভাগ ভবনগুলোতে পার্কিং স্পেস রাখা হতো৷ তবে সময়ের সাথে আবারো পার্কিং গুলোতে গড়ে উঠেছে নানান স্থাপনা৷ এমনকি ১/১১ এর সময় দোকান উচ্ছেদ করে উদ্ধার করা পার্কিং স্পেস গুলোতে আবারো দোকান নির্মিত হয়ে গেছে৷ সচেতন মহল বলছে, নগরীতে নির্মিত বহুতল ভবন গুলোর গাড়ি নিজ নিজ ভবনের পার্কিং স্পেসে রাখা সম্ভব হলে তবেই সড়কে গাড়ি রাখা বন্ধ করা সম্ভব হবে৷ তবে বিদ্যমান পরিস্থিতি সামাল দিতে এলাকা ভিত্তিক খালি জায়গা চিহ্নিত করে সেসব স্থানে পার্কিং ব্যবস্থা চালু করলে সড়কের ওপর থেকে অবৈধ পার্কিং উঠানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।