আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করি। আমাদের সুখে-দুঃখে-সংকটে তিনি প্রবলভাবে উপস্থিত সব সময়। জাতিসত্তাবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি যেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন নিরন্তর প্রেরণার উৎস।
তারই একটি উদ্ধৃতি দিয়ে ‘জীবন হবে আদর্শের ও উদ্দীপনাময়’ রচনাটি শুরু করতে চাই। শিক্ষা প্রসঙ্গে ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ জানাতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘যেখানেই হউক না কেন, মানবসাধারণের মধ্যে যা কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলিতেছে তাহা ভালো করিয়া জানারই একটা সার্থকতা আছে, পুঁথি ছাড়িয়া সজীব মানুষকে প্রত্যক্ষ পড়িবার চেষ্টা করাতেই একটা শিক্ষা আছে।’মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলে। মানুষের জন্মের পরই তার শুরু। আর সে বিষয়ে গভীরভাবে জানার কথা বলেছেন তিনি।
আমরা নিশ্চয় জানি, নবজাতকটি বস্ত্র পরিহিত থাকে না, সে কোনো জ্ঞান নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, কিন্তু মায়ের শরীর ত্যাগের পরে চিৎকার করে জানিয়ে দেয় তার আগমনবার্তা। মা অপার শান্তি লাভ করেন যখন কান্নার আওয়াজ শোনেন। আত্মীয়স্বজন নিশ্চিত হন একটি সুস্থ বাচ্চা নিশ্চয়ই আমরা পেতে যাচ্ছি। সে কি অপার আনন্দ! আমরা যারা ষাটোর্ধ্ব নাতি-নাতনি পেয়ে অনেকেই ভুলে যেতে বসি নিজ সন্তানকে। নাতি-নাতনি হলো দাদু-দিদার কাছে সুদ ও আসল অর্থাৎ অঙ্কের ভাষায় সুদাসল।
আমরা পাঁচটি বিশেষ অনুভূতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করি, যেমন- Touchবা স্পর্শ যা ত্বকের সাহায্যে গ্রহণ করি,Taste বা স্বাদ যা জিবের সাহায্যে গ্রহণ করি এবং যা কিনা শুধু জিবের দুই ধারেই বেশি থাকে; ঝরমযঃ বা দৃষ্টি যা চোখের মাধ্যমেই হয়ে থাকে; ছোট দুটি Eye ball দিয়ে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেমন অবলোকন করি, তেমন কুৎসিত জিনিসগুলো আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না।
নাসিকারন্ধ্র গন্ধ নেওয়ার জন্য এমনভাবে সাজানো আছে যা নাকের ভেতরের দিকে সবচেয়ে উপরিভাগে থাকে এবং দুই নাকেই সমানভাবে থাকে, যাকে বলে গন্ধ গ্রহণের চিহ্নিত এলাকা। এত সুরক্ষিত জায়গায় থাকার পরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু, অদৃশ্য ভাইরাস সংক্রমণে, মাথা বা নাকে আঘাতের কারণে তা অনেক সময় চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।
শ্রুতির জন্য দুটি কান নিয়েই আমরা পৃথিবীতে এসেছি, পৃথিবীর সব শব্দ, অর্থাৎ পাখির কলতান, বাতাসের ঝিরঝির, সমুদ্রের গর্জন, পাতার মর্মর, সর্বোপরি মায়ের মুখের মিষ্টি শব্দ শোনার জন্য। দুটো কানের ব্যাপারে নিশ্চয়ই স্রষ্টা ভেবেছিলেন দৈব-দুর্বিপাকে একটি চলে গেলেও যেন অন্যটি দিয়ে মানবসন্তান বিকলাঙ্গ বা পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং ১০টি লোকের মধ্যে মিশে থাকতে পারে গ্লানিহীনভাবে ভাব ও বাক্যের আদান-প্রদানের মাধ্যমে।
অর্থাৎ চোখ, কান, নাক, ত্বক, জিব এ পাঁচটি ইন্দ্রিয় যথাক্রমে দৃষ্টি, শ্রুতি, গন্ধ, স্পর্শ ও স্বাদের জন্য সৃষ্টি হয়ে থাকলেও তাদের সমন্বয় শুধু একটি জ্ঞানকেই বিকশিত করে না, তাদের সবকিছুর অর্থাৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সমষ্টিগত ব্যবহারে সৃষ্টি হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা জ্ঞান, তা হলো সাধারণ জ্ঞান। এ কমন সেন্স দ্বারাই আমি যোগ্যতা অর্জন করি জিনিসটি কেমন তা দেখতে এবং কোনো কাজ সম্পাদন করতে, যা যেমনভাবে করা উচিত।
তাই বলা হয়, শিক্ষা ও জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার অর্থহীন যদি সাধারণ জ্ঞানের অভাব থাকে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘জীবনের পরম সত্য এই- শক্তিই জীবন, দুর্বলতাই মৃত্যু। শক্তিই সুখ ও আনন্দ, শক্তিই অনন্ত ও অবিনশ্বর জীবন; দুর্বলতাই অবিরাম দুঃখ ও উদ্বেগের কারণ; দুর্বলতাই মৃত্যু।’ তাই আমাদের সব দুর্বলতা পরিহার করে নিজের জ্ঞান ও পরিশ্রমের মাধ্যমে শক্তি অর্জন করতে হবে। শক্তি হবে নৈতিক। আদর্শের।
কালোকে কালো বলতে না জানা, ভালোকে ভালো বলতে অপারগতা, সুন্দরের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে বুঝেও না বোঝার ভান করা, সত্যকে অসত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যাওয়ার অপচেষ্টা এসব হয় শুধু পাঁচটি স্পেশাল সেন্স বা পঞ্চ ইন্দ্রিয় এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অর্থাৎ কমন সেন্সের অভাবে এবং এ পঞ্চ ইন্দ্রিয় জন্ম দেয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের এবং এ দুটির সংমিশ্রণেই হয় ‘বিবেক’।
যে বিবেক হলো মানুষের কাছে আদালত। বিবেকবান মানুষ যেমন সমাজে সুষ্ঠু বিচার আনতে পারে, তেমন বিবেকহীন মানুষ পশুর মতো ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যেতে পারে এবং সব সময় প্রশাসন বা গুরুজনের সঠিক সুন্দর ও মঙ্গলময় চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে অর্থাৎ বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা।
এখন প্রশ্ন হলো সাধারণ জ্ঞান, বিবেক বা মনুষ্যত্ব লাভ করতে হলে দরকার হয় শিক্ষা, যা প্রথমে মায়ের কোল থেকে। মা রান্নার সময় চুলোয় লাকড়ি দিতে গেলে যেমন সতর্কতা অবলম্বন করেন, গ্যাসের চুলায় রান্নার সময় যেভাবে বিভিন্ন ধরনের উপাদান তৈরিতে বিভিন্ন তাপমাত্রা ব্যবহার করেন, তেমন শিশুকে কোলে নেওয়ার সময় যে মোহনীয় স্পর্শ তাকে করেন, সেখান থেকেও কিন্তু শিশু বুঝে নেয় সে মায়ের কোলে নাকি অন্য কোথাও। মায়ের স্পর্শ নিদারুণ যন্ত্রণায় কাতর একটি শিশুর কান্না থামিয়ে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে অন্য আপনজনের কোল বা স্পর্শ তা এনে দিতে পারে না। এখান থেকেই শিশু নিরাপদ আশ্রয় শুধু Touch বা স্পর্শের মাধ্যমেই লাভ করে থাকে। তার পরই শুরু হয় পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা।
স্কুলশিক্ষকের ভূমিকা মা-বাবার ভূমিকার চেয়েও কঠিন। বিনা আর্থিক বিনিময়ে যিনি সবকিছু উজাড় করে দেন তিনিই খুঁজে পাবেন একটি ক্লাসের ৪০ জন ছাত্রের শুধু চারজন জ্ঞানের ঝরনাধারায় এবং তৃপ্তি নিয়ে পান করে যাচ্ছে। তরুণরাই তাদের তারুণ্যের শক্তি দিয়ে যে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে। তারা আধুনিক মনমানসিকতাসম্পন্ন। তারা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত সামাজিক চরিত্র ও কাঠামোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে যুগের চাহিদা মোতাবেক নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। একইভাবে তারা ভবিষ্যৎ চাহিদার জন্য তৈরি হতে পারে। পরিবারের পর শিক্ষকের ভূমিকা সমাজে সবচেয়ে মূল্যবান। শিক্ষকের আদর্শ, রীতিনীতি, নৈতিক মূল্যবোধ সমাজকে আলোকিত করে। সমাজকে এগিয়ে নেয়।
স্কুল ও কলেজ অর্থাৎ দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা বয়সের এক দুর্ভেদ্য সময় অতিবাহিত করে, ইংরেজিতে ঞববহ ধমব বলা হয় তেরো থেকে উনিশ। এ বয়সেই ছেলেমেয়েরা ছেলে ও মেয়ে হতে শেখে, ভুল পথে না বুঝে পা বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রলোভিত, প্রতারিত বা প্ররোচিত হতে পারে। এখানেই পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কঠিন নজরদারি ছেলেমেয়েদের সঠিক পথ চেনাতে সাহায্য করে।
সন্তানের প্রতি উদাসীনতা বা কঠোর নজরদারির খেসারত পশ্চিমা জগৎ দিয়ে যাচ্ছে এবং আমরাও ওই পথেই পা বাড়াচ্ছি। এ বয়সের ছেলেমেয়েরাই ‘জানে না’ এ কথাটি স্বীকার করতে রাজি নয়, ‘বোঝে না’ এ কথাটা বুঝতে অক্ষম, ভাব থাকে সবজান্তা। এদের কিন্তু বোঝালে বোঝে। জানি না বলা কোনো লজ্জার ব্যাপার নয়, জানতে অনাগ্রহ এবং সঠিক কাজ সঠিকভাবে করতে অস্বীকৃতিই লজ্জাজনক। নিজের জ্ঞান বা বুদ্ধি সম্পর্কে ভুল ধারণা বা ভুল বিশ্বাসই অজ্ঞতা।
শুধু বোকারা অদ্ভুত মাত্রায় অন্ধবিশ্বাসে থাকে সেটা তাদের অজ্ঞতা ও অদক্ষতা যা তারা কখনো স্বীকার করে না। বলা হয় The application of Education and Knowledge without commonsense is meaningless. ২০-অনূর্ধ্ব এই ছেলেমেয়েরা যদি এটুকু জ্ঞান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভের জন্য ভর্তি হয় তা হলে তারা Ragging-এর নামে, ছাত্র নির্যাতনের নামে উল্লাস করতে পারে না।
ক্ষুদ্র জ্ঞান যেমন বিপজ্জনক, তেমন প্রচণ্ড অজ্ঞতাও ক্ষতিকারক। অজ্ঞতার কারণে মানুষ নিজেকে ছোট করে রাখে, ভীতু হয়ে থাকে; কখনো কখনো নিজের ভ্রান্ত মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালায় অথবা অন্যের সঠিক মতকে দূরে ঠেলে দেয়, হয়ে পড়ে আত্মকেন্দ্রিক, কারণ অভিজ্ঞতা বা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমন ধারণা পোষণ করেই তারা দম্ভ দেখাতে চায়।
তবে এ কথা সত্য, একজন ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও জীবনে সার্থকতা লাভ করতে পারে এবং তার আকাক্সক্ষার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছাতে পারে যদি সে পাঁচটি ঈ-এর পূর্ণতা লাভ করতে পারে : Character, Commitment, Conviction, Courtesy & Courage অর্থাৎ সুদৃঢ় এবং সৎ চরিত্র, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠা, দৃঢ়বিশ্বাস এবং জনকল্যাণের দর্শন, ভদ্র ও নম্র ব্যবহার মানুষকে প্রীত ও সাহায্য করে, সর্বোপরি সৎ কাজ বাস্তবায়নে সৎ ও কঠিন সাহস জোগান দেয়।
জ্ঞান অর্জনই হওয়া উচিত একজন মানবসন্তানের মূল লক্ষ্য, যা অর্জনের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই, বয়স নেই এবং শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথের এই প্রেরণাময়ী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কর্মতৎপরতা আমরা বিশেষভাবে অনুভব করতে পারি। বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি। আসলে পঞ্চ ইন্দ্রিয়, ষষ্ঠ সাধারণ জ্ঞান যাদের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় মানুষের বিবেক। সে বিবেকও শানিত হয় মানবজাতির প্রতি প্রকৃতির সবচেয়ে বড় দান চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়ে। এ চিন্তাশক্তি দিয়েই মানুষ তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে থাকার ও বাঁচার জন্য। এ পরিবেশ কিন্তু প্রাণিকুল সৃষ্টি করতে পারে না, বরং তারা সে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শেখে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, শুধু অল্পসংখ্যক মানবসন্তান প্রকৃতির অকৃপণ দান চিন্তা করার ক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারে। তাই জ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞানই হলো বিবেক, চিন্তা এবং চেতনার মূল ভিত্তি।
লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়