চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবীসহ নানা স্তরের মানুষের বিভিন্ন দাবির মুখে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজ নিজ দাবি আদায়ে রাস্তায় নামেন তাঁরা।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সচিবালয়, প্রেস ক্লাব, শাহবাগ ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের আশপাশ ঘিরে বিভিন্ন কর্মসূচি থাকায় এসব এলাকায় পথচারী এবং যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত রবিবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে সচিবালয় এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বাসভবন যমুনার আশপাশে সব ধরনের গণজমায়েত, সভা, সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রদর্শন ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এর পর থেকে দাবি আদায়ে সড়কে আন্দোলনকারীরা নেই বললেই চলে। তবে তাঁরা নিজ নিজ দপ্তরে বিক্ষোভ, সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে এসব দপ্তরের সার্বিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর মাত্র তিন সপ্তাহ ধরে দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এই অল্প সময়ের মধ্যে তারা কিছু কাজ গুছিয়ে ওঠার আগেই পেশাজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ নিজ নিজ দাবিতে নানা কর্মসূচি দিতে থাকেন, যা এক ধরনের চাপের মধ্যে ফেলে বর্তমান সরকারকে।
গত রবিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখকষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি।
আমাদের যদি কাজ করতে না দেন, তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দাবিদাওয়া নিয়ে মাঠে নামে একাধিক গ্রুপ। গত ২০ আগস্ট কিছু এইচএসসি পরীক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানায়। তারা সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের ১৮ তলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উঠে যায়।
শিক্ষার্থীরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ দপ্তরের সামনে অবস্থান নেয়। এ সময় সচিবালয়ের সব প্রবেশপথ আটকে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তাদের দাবি মেনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার পর থেকে জোরালো হয় অন্যদের আন্দোলন। তারা মনে করে, চাপ দিলেই দাবি আদায় সম্ভব।
গত কয়েক দিনে অন্তত অর্ধশত গ্রুপ দাবি আদায়ে সভা-সমাবেশ করে। যেহেতু এসব দাবি পূরণে বড় অঙ্কের আর্থিক বিষয় রয়েছে, তাই এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।
সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে গত রবিবার। ওই দিন সকাল থেকে আনসার সদস্যরা তাঁদের চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সচিবালয়ের আশপাশে অবস্থান নিয়ে পুরো এলাকা বন্ধ করে দেন। এক পর্যায়ে ওই দিন রাতে তাঁরা বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাকেও সচিবালয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একধিক সমন্বয়ক ছিলেন। খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা সেখানে গেলে সংঘর্ষে ৫০ জনেরও বেশি আহত হন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি-কাম-প্রহরী পদটি জাতীয়করণসহ তিন দফা দাবি আদায়ে গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি করেন তাঁরা।
চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের দাবিতে গত ১৮ আগস্ট বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি করেছেন সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (সেসিপ) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সচিবালয়ের পাশেই শিক্ষা ভবনের গেট বন্ধ করে তাঁরা পর পর দুই দিন আন্দোলনে নামায় আশপাশের সড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া অনেকে দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পান। তাঁরা চাকরি স্থায়ী করার দাবি নিয়ে ঢাকায় সমবেত হন। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ওয়াসা, ডেসা, সচিবালয় কর্মচারী থেকে বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের দাবি নিয়ে মাঠে আছেন। তাঁদের প্রধান অসন্তোষের কারণ পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়া, চাকরি স্থায়ী না করা। আবার যাঁরা বিভিন্ন সময় চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তাঁরাও চাকরি ফিরে পেতে মাঠে নেমেছেন।
গ্রাম পুলিশের সদস্যরাও গত ১৮ আগস্ট ঢাকায় আসেন। চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে তাঁরা সমবেত হন। গত সোমবার প্যাডেলচালিত রিকশার চালকরা তাঁদের এক দফা দাবি আদায়ে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে শাহবাগ ছাড়েন। তাঁদের দাবি—শহরের মূল সড়কে ইঞ্জিনচালিত রিকশা চলতে পারবে না।
এদিকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে একীভূত করার দাবিতে আলটিমেটাম দিয়েছেন সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পাশাপাশি অভিন্ন সার্ভিস কোড বাস্তবায়ন, চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিত কর্মচারীদের চাকরি নিয়মিতকরণের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। এ জন্য কর্তৃপক্ষকে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন ৮০ সমিতির প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। দাবি পূরণ না হলে গত বুধবার থেকে স্টেশন ত্যাগ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণছুটির কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তবে পরে তাঁরা সে কর্মসূচি স্থগিত করেন।
এ ব্যাপারে সরকারের সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভ, দুঃখ, বঞ্চনা আছে। তাঁদের কণ্ঠ তো রোধ করা যাবে না। তাঁদের বলতে দিতে হবে। আর সরকারের সামনেও সুযোগ, গণমানুষের সমস্যা শোনার। কিন্তু তাঁরা যেভাবে রাস্তায় নেমে আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁদের কথাগুলো বলছিলেন, তা আসলে সরকারের জন্য চাপে পরিণত হয়। এই চাপ বা জবরদস্তি থেকে সবাইকে সরে আসতে হবে। তাঁদের গণতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কথাগুলো বলতে হবে। আর অন্তর্বর্তী সরকারকেও তাদের কথাগুলো শুনে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে।’