ছাত্রজনতার আন্দোলনে যে দুই নারীর অবদানের গল্প কেউ জানে না
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৪, ২:১১ PM
হাসপাতালগুলোর সামনে মোতায়েন করা ছিল পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হতে পারে আন্দোলনে আহতদের। ধানমন্ডি-২৭ এর কাছাকাছি অবস্থানে থাকা ইবনে সিনা ও সিটির মতো হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের চাপ। কারণ, কিছু কিছু হাসপাতাল রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করতে চেয়েছিল, কেউ কেউ অতিরিক্ত টাকা নিয়েছে, কেউবা আহতদের ফিরিয়ে দিয়েছে।
পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন দুই তরুণ চিকিৎসক—ডা. অর্থি জুখরিফ এবং ডা. হৃতিশা আক্তার মিথেন। চারিদিকে যখন ভয়, অনেকে যখন নিজেদের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন নিজেদের দুয়ার খুলে দেন তারা। তাদের বাড়ির নিচের গাড়ির গ্যারেজকে পরিণত করেন এক অস্থায়ী ক্লিনিকে।
১৮ জুলাই দুপুর ২টা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ধানমন্ডি-২৭ নম্বর সড়কসহ আশেপাশের গলি ভরে যায় কাঁদানে গ্যাসে। চারিদিক থেকে আসতে থাকে গুলির শব্দ। ইবনে সিনা হাসপাতালের ওটি সহকারী এবং একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে হেলথ শো উপস্থাপক ডা. অর্থি বলেন, 'আমার জীবনে ওই প্রথম এত ভয়ংকরভাবে নিজের এত কাছাকাছি কোথাও গুলির শব্দ শুনেছিলাম। তার আগে তো শুধু নাটক-সিনেমায় গুলির শব্দ শুনেছি।'
বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখতে পান, আহত শিক্ষার্থীরা নিচে পড়ে আছে। তাদের পোশাক ভিজে গেছে রক্তে। চোখে-মুখে আতঙ্ক। ডা. অর্থি বলেন, 'একটাই ভাবনা এসেছিল, আমি এভাবে কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে এসব দেখতে পারি না।'
একজন চিকিৎসক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে তিনি নিচে ছুটে যান। ওই বাড়ির আরও কয়েকজন বাসিন্দাও ততক্ষণে নেমে এসেছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ল্যাবএইড বিশেষায়িত হাসপাতালের সাবেক মেডিকেল অফিসার ডা. মিথেনও। ডা. মিথেন বলেন, 'মানবতা—শুধু এই একটি কারণেই সেদিন সব করেছি। নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।'
ডা. অর্থি জুখরিফ
ভয়ে অনেক বাড়ির গেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। কিন্তু বন্ধ হয়নি ডা. অর্থি ও মিথেনের বাড়ির গেট। বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের সহযোগিতায় তারা আহতদের সেবা দিতে শুরু করলেন। তারা যতটা পেরেছে ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক্স, গজসহ প্রাথমিক চিকিৎসার সামগ্রী নিয়ে এসেছে।
প্রথমে তারা বাড়িটির গেটের ভেতরে আহতদের চিকিত্সা দিতে শুরু করেন। পরে আহত আরও মানুষ আসতে থাকায় একপর্যায়ে সেখানে দুটি অস্থায়ী শয্যা স্থাপন করা হয়। ডা. অর্থি ও মিথেন আহত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যান পরিবারের একজন সদস্যের মতো করে। ছররা গুলি বের করেছেন, আঘাতের ক্ষত ড্রেসিং করেছেন, তাদের মানসিক শক্তি দিয়েছেন।
ডা. অর্থি বলেন, 'আঘাতগুলো ছিল ভয়ংকর। তাদের পিঠ, মাথা, বুক শটগানের গুলিতে ছিদ্র হয়ে গেছে। কিছু গুলি পেশীতে আটকে গেছে। অন্তত ১০ জনের গুলি লেগেছিল চোখে।' এই আহত রোগীদের চিকিৎসায় অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গুরুতর আহত রোগীদের তারা পাঠিয়ে দিয়েছেন বিশ্বস্ত ও আগ্রহী কয়েকটি ক্লিনিকে।
এর মধ্যে একজন রোগী গভীরভাবে দাগ কেটে গেছেন ডা. জুখরিফের হৃদয়ে। ১০ বছর বয়সী সেই ছেলেটির সারা শরীরে ছিল ছররা গুলির ক্ষত। ডা. অর্থি বলেন, আমি তাকে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলি। কিন্তু কয়েকঘণ্টা পরা সে আবার এলো। দেখি তার কপালে ফুলে আছে। গুলি লেগেছে। আবারও তাকে চিকিৎসা দেই। তারপর সে চলে যায়। দুঃখজনকভাবে, ওইদিনই সংঘর্ষে ছেলেটি নিহত হয়।
পরেরদিন ছিল কারফিউ। উপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে টহল দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার মধ্যেই আহত শিক্ষার্থী, অভিভাবক, পথচারী এবং সাধারণ মানুষের চিকিত্সা চালিয়ে যান এই দুই চিকিৎসক। তাদের কাছে চিকিৎসা সামগ্রী তেমন বেশি ছিল না। খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো শেষ হতে থাকে।
কিন্তু তাদের ভবন মালিক সমিতির সহযোগিতায় বিভিন্ন ফার্মেসি মালিকদের কাছ থেকে আরও সামগ্রী আনতে সক্ষম হন। শিক্ষার্থীরাও যে যতটা পেরেছে নিয়ে এসেছে। তাদের এই অস্থায়ী ক্লিনিকের কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ালে আহত আরও অনেকে চলে আসেন চিকিৎসা নিতে।