ঐক্যের আহ্বান ও ইসলামের বার্তা মাধ্যমে শেষ হলো তিন দিনব্যাপী ঐতিহাসিক তাফসীরুল কোরআন মাহফিল। তিনদিন ব্যাপী এ আয়োজনে শেষদিন শুক্রবার বিকেলে ঢাকা থেকে বিমান জুগে যশোরে এসেছিলেন দেশসেরা দুই বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ ও ড. মিজানুর রহমান আজহারি।
ইসলামের বার্তা ও ঐক্যের আহ্বান জানান ওই দুই বক্তা। আর তাদের বয়ান শুনতে খুলনা, বাগেরহাট ,সাতক্ষীরা, নড়াইল চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর মাগুরা কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ, গোপালগঞ্জ পিরোজপুর সহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছিলেন যশোরের পুলেরহাটে আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজ মাঠে। ইসলামী বক্তব্য চলে রাত দশটা পর্যন্ত। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে ঐতিহাসিক তাফসীরুল কোরআন মাহফিলে লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটে।
আদ্বদীন ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ মাহফিলকে ঘিরে যশোর শহরের একাংশ, মুড়লি, টার্মিনাল, চাঁচড়া পুলেরহাট, নতুনহাট, ধর্মতলা, আরবপুর পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়। অনেকেই মাহফিল পর্যন্ত পৌছাতে না পেরে বাড়িতে ফিরে যান। আবার অনেকেই মোবাইলে ইউটিউবে সরাসরি তাফসিরুল কোরআনে মাহফিল শোনেন।
শুক্রবার বেলা বাড়ার পরপরই এলাকা কানায় কানায় মুসল্লিরা ভিড় জমায় ।জুম্মার নামাজের আগেই আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজের ভেতরে লোকারন্য হয়ে যায় এবং সেখানে লাখ লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণে জুম্মার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। বেলা ছোয়া তিনটা থেকে শুরু হয় আলোচনা ও ইসলামি সঙ্গিত ও গজল। রাত নয়টায় মিজানুর রহমান আজহারী মঞ্চে উঠেন। এ সময় তিনি বলেন,মানুষ আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কোরআনের কেন্দ্রীয় আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হলো মানুষ। "মানুষ ভালো হলে ফেরেশতাদের থেকেও ভালো, কিন্তু খারাপ হলে পশুর থেকেও খারাপ হয়। মানুষের জীবন শুরু হয় বিজয় দিয়ে,এবং সে মৃত্যুকে ছাড়া সব কিছু জয় করতে সক্ষম।
তরুণ প্রজন্মের প্রতি বিশেষভাবে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন,যশোরের তরুণরা এবং দেশের জেনারেশন নতুন করে দেশ সাজানোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে কোরআনের আলোকে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।" তিনি আরও বলেন,"মুসলিমদের উচিত গণভবন, বঙ্গভবন, ডিসি অফিস এবং এসপি অফিসেও কালেমার পতাকা উড়ানোর স্বপ্ন দেখা।"
ড.আজহারি বর্তমান সমাজের দুর্নীতি ও শোষণের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, "একদল মানুষ এতদিন ধরে দেশের সম্পদ লুটপাট করে খেয়েছে। আরেকদল খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।" তার এ বক্তব্য উপস্থিত মুসল্লিদের মধ্যে একধরনের সাড়া জাগিয়ে তোলে। তিনি সবাইকে অনৈতিকতা থেকে মুক্ত থেকে সৎপথে চলার তাগিদ দেন।
মানুষের ঈমানি শক্তির ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, "মানুষের কাছে আল্লাহ সমস্থ কিছু নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। যদি আমরা কোরআনের শিক্ষা মেনে চলি, তাহলে আমরা ব্যক্তি, পরিবার এবং পুরো দেশকে বদলে দিতে পারি।"
ড. আজহারি তার আলোচনায় ১০ জন বিশিষ্ট সাহাবীর উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, সাহাবীদের মধ্যে যে যার প্রতিভা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, "প্রত্যেকের প্রতিভা ও যোগ্যতা আল্লাহ প্রদত্ত। আমাদের উচিত এই প্রতিভাকে চিহ্নিত করে সঠিক কাজে নিয়োজিত করা।"
ড. আজহারির আলোচনার শেষে একটি বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। তিনি দেশ, জাতি এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি, উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য দোয়া করেন। মাহফিলে উপস্থিত লাখো মানুষ তার এই আলোচনায় মুগ্ধ হন এবং দোয়ার সময় আবেগে আপ্লুত হন। এসময় তিনি যশোরবাসীর উদ্দেশ্যে ছেলে সন্তান হলে তার নাম মুসহাব রাখার পরামর্শ দেন।
এরআগে মঞ্চে উঠেন আরেক বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ। তিনি সুরা হুজুরাতের ১৮টি আয়াতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য থেকে সাতটি বিশেষ বার্তা মুসলিম উম্মাহর জন্য তুলে ধরেন।
শায়খ আহমাদুল্লাহ সুরা হুজুরাতের আলোকে মুসলিম সমাজে শিষ্টাচার, সত্য যাচাই, ঐক্য এবং সম্প্রীতি বজায় রাখার ওপর জোর দেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, মুসলমানদের সব সময় ইসলামি শিষ্টাচার মেনে চলা উচিত। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সুন্দর আচরণ এবং ভদ্র ভাষায় কথা বলা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। তথ্য যাচাই ছাড়া কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা বা গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকা জরুরি থাকার আহবান জানান।
শায়খ আহমাদুল্লাহ আরো বলেন, এই আয়াতগুলো শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য জীবন পরিচালনার একটি চমৎকার নির্দেশনা। এই শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারলে মুসলিম উম্মাহ আরো শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠবে।
এরআগে মঞ্চে হাজির হন আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. শেখ মহিউদ্দিন। তিনি খুলনা বিভাগের মানুষের জন্য আগামি মার্চ পর্যন্ত ফ্রি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালুর ঘোষনা দেন। পরবর্তিতে মঞ্চে আসেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। তিনি বলেন,৫ আগস্টের আগে এ ধরণের আয়োজন করা সম্ভাব হয়নি। আমরা কল্পনা করিনি এমন আয়োজন করতে পারবো। ইসলাম ও কুরআন হাদিসের কথা এখন মানুষ নির্ভয়ে বলতে পারে।
এদিকে,মাহফিলস্থলসহ পুরো যশোরে ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ লক্ষ্য করা গেছে। মাহফিলে ১০ লাখের বেশী মুসল্লি সমবেত হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। রাত দশটা পর্যন্ত চলে ড. মিজানুর রহমান আজহারির বক্তব্য।
এদিকে ওয়াজ মাহফিলে শুনতে এসে মানুষের ভিড়ে পদদলিত হয়ে প্রায় ২০ জন নারী পুরুষ আহত হয়েছে। মিলাদ মাহফিলের শেষ দিনে প্রচন্ড ভিড়ের কারণে পদদলিত হয়ে তারা আহত হয়।আহতদেরকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পদদলিত হয়ে আহতরা হচ্ছে, মইনুল ইসলাম (৩২), ওসমান গণী (১৮), জিয়ান (২১), মারজান (১৮), ইব্রাহীম (৪০), মাসুদ (২৬), সাইদুল (২৮), লাবলী (৩০) ও আফিফাসহ (১৪) প্রায় ২০ জন। প্রচন্ড ভিড়ের কারণে পদদলিত হয়ে আহত হন। আহত অন্যান্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ জুবাইদা ইসলাম জানান, আহতরা সকলেই পদদলিত হয়ে কমবেশি আহত হয়েছেন। তাদের মহিলা ও পুরুষ সার্জরি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। সকলেই আশঙ্কামুক্ত রয়েছে।