সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫ ৮ বৈশাখ ১৪৩২
সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫
৪৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী নড়াইলের গোয়ালবাথান মসজিদ
জান্নাতুল বিশ্বাস, নড়াইল
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫, ৮:৫০ PM
নড়াইল সদর উপজেলার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাথান জামে মসজিদ। প্রায় ৪৫০ বছর আগে নির্মিত মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। 

ধারণা করা হয়, নড়াইলে এটিই সবচেয়ে পুরোনো মসজিদ  এটিই। মসজিদের পাশে বিশার আকারের পুকুর রয়েছে। পুকুরের শান্ত জলরাশির সঙ্গে মসজিদের নান্দনিক সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। প্রতিদিনই দূর-দূরান্তের মানুষ এখানে ভিড় করেন।

ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটির অবস্থান নড়াইল জেলা শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের চালিতাতলা বাজার। বাজার পার হয়ে এক কিলোমিটা রাস্তা সোজা গিয়ে ডানদিকে গোয়ালবাথান গ্রাম। ধুড়িয়া গ্রামে যাবার পথে রাস্তার বামপাশে নীল রংয়ের ছোট একটি মসজিদ। এটাই গোয়ালবাথান জামে মসজিদ। চারিদিকে বনজঙ্গলে ঘেরা এই মসজিদটিই জেলার সবচেয়ে পুরাতন মসজিদ। প্রায় ৪৫০ বছরের পুরাতন গোয়ালবাথান মসজিদ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৫ একর ৭০ শতক জায়গার উপর নির্মিত মসজিদটি। মসজিদের দৈর্ঘ্যে ৫০ ফুট ও প্রস্থে ৩৫ ফুট। ছোট ছোট ইট আর চুন সুরকীর গাথুনিতে এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। উপরে চারটি ছোট মিনার রয়েছে। বজ্রপাত নিরোধক লোহার দণ্ড রয়েছে। কোন পিলার নাই। কোন রড়ের ব্যবহার ছাড়াই মসজিদের গম্বুজটি অপূর্ব স্থাপত্য নির্মাণ শৈলী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। জনশ্রুতি রয়েছে এই মসজিদটি জ্বীনদের দিয়ে নির্মাণকাজ করা হয়েছে। ওই সময় জ্বীনরাও নামাজ আদায় করতেন এই মসজিদে।

এলাকায় জনশ্রুতি আছে... মোগল শাসনামলে প্রায় ৪০০ বছর আগে একদিন এই গ্রামে এসে হঠাৎ করে বসবাস শুরু করেন মুন্সী হবৎউল্লাহ নামে এক ব্যক্তি। এর কিছু দিন পর তিনি এক রাতে ওই স্থানে এ মসজিদ এবং এর সংলগ্ন একটি পুকুর খনন করেন। সেই থেকে ওই গ্রামে আস্তে আস্তে জনবসতি শুরু হয় এবং ওই স্থানসহ আশপাশের এলাকার মুসলিম স¤প্রদায়ের মানুষরা ওই মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করতে থাকেন।

এলাকাবাসী জানান, ওই এলাকায় কোনো মানুষের বসতি ছিল না। বাগানে ভরা ছিল এলাকাটি। মুন্সী হবৎউল্লাহই ওই গ্রামের প্রথম বাসিন্দা ছিলেন। তার বসবাস শুরুর পর কোনো এক রাতে ওই মসজিদ এবং তার সঙ্গে লাগোয়া একটি পুকুর খনন করা হয়।

মসজিদটি তৈরির সঠিক সময়কাল বলতে পারেন না এলাকার লোকেরা তবে ৪০০ থেকে ৪৫০ বছরের পুরাতন বলে ধারণা স্থানীয়দের। তাদের তথ্য মতে মোঘল আমলে মুন্সি হয়বৎউল্লাহ নামের এক বুজুর্গ ব্যক্তি কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গোয়ালবাথান গ্রামে বসতি গড়েন। তিনি কোথা থেকে এসছেন সে কথা কেউ বলতে পারে না। এই অঞ্চলে তখন গরু চরানোর কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তিনি জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা তৈরি করে বসতি গড়া শুরু করেন। একদিন তিনি ঘর তৈরি করতে জঙ্গলের কয়েকটি গাছ কেটে ফেলেন। একদিন রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন “বাড়ি তৈরি না করে মসজিদ বানা” একই স্বপ্ন তিনি পরপর তিনরাত দেখেন। এই স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি।
এলাকাবাসী জানান, আশেপাশের পুরো এলাকায় তখন সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীদের বসবাস। তিনি নিজের সঙ্গী ও কয়েক কিলোমিটার দুর থেকে মুসল্লিদের ডেকে এনে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন এবং তাদের সহায়তায় মসজিদটি নির্মাণ করেন। একই সময়ে এলাকার মানুষের সুপেয় পানির জন্য মসজিদ সংলগ্ন বিশাল আকৃতির পুকুর খনন করা হয়।

কথিত আছে- এলাকার লোকেরা হঠাৎ গড়ে ওঠা এই মসজিদ এবং বিশাল আকৃতির পুকুর দেখে অবাক হয়ে যান। তাদের ধারণা বিশাল এই পুকুর খনন করা এবং মসজিদটি এক রাতের মধ্যেই নির্মিত হয়েছে। জ্বিন দ্বারা বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছিলো বলে এলাকায় এটিকে জ্বিনের মসজিদ নামেও ডাকা হয়। এলাকার মুসল্লিরা বিশ্বাস করেন সে সময় জ্বিনেরা এখানে নামাজ পড়তো। এক সময়ে শুক্রবারে জুমার নামাজ আদায় করতে দূর থেকে পায়ে হেঁটে মুসল্লিরা এখানে আসতেন। এখানে আসা মুসল্লিরা মুন্সি হয়বৎউল্লাহ সাহেবের আশ্রয়ে থেকে খাওয়া দাওয়া করে চলে যেতেন। সপ্তাহের সাত দিনই নানা ধরনের কয়েকশত মুসাফিরের খাওয়া আর বিশ্রামের ব্যবস্থা ছিলো এখানে।

মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি মাওলানা তাইয়েবুর রহমান বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, আমরা জেলা পরিষদসহ বিভন্ন জায়গা থেকে অর্থ চেয়ে এনে মসজিদটি সংস্কার করছি। মসজিদে একটি ভালো বাথরুম কিংবা পানির ব্যবস্থা নাই। আমরা আশা করি এটি প্রত্মতত্ত বিভাগ তাদের আওতায় নিয়ে মসজিদটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে।

যশোর জেলার রাজিব আহসান বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, আমি গোয়ালবাথান মসজিদে এসে নামাজ আদায় করেছি। ৪০০ বছরের পুরোনো এই মসজিদটি দেখে খুব ভালো লেগেছে। এই মসজিদটি প্রত্মতত্ত বিভাগের উদ্যোগে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা হলে আরো ভালো হতো।

মসজিদের ইমাম মুন্সি রহমতউল্লাহ বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, আমার পূর্বপুরুষের গড়া এই মসজিদ। এখানে এক সময় শুক্রবারে বিশাল আকারের জুম্মার নামাজ আদায় হতো। ৫০ থেকে ৬০ মাইল দুর থেকে এখানে নামাজ আদায় করতে আসতেন মুসল্লিরা। আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া হতো, সেই বিশাল আকৃতির হামান দিস্তাসহ মসলা বাটার অনেক পুরাতন তৈজসপত্র ছোটবেলায় দেখেছি। এখানে ইমামতি করতে পেরে গর্ব অনুভব করছি।
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত