মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫ ৯ বৈশাখ ১৪৩২
মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫
গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা গণতন্ত্র মানে না
রেজাউল করিম
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০২২, ৫:০৫ PM
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার কলোনি পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ নিজেদেরকে গণতন্ত্রের ধারক, বাহক ও প্রচারক হিসেবে দাবি করে। তারা নিজ দেশের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও পরদেশের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। পরদেশে তারা সুবিধাবাদী। সেখানে গণতন্ত্র বড় কথা নয়, স্বার্থ ও দলবাজিই বড় কথা। নিজ স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে, তারা গণতন্ত্র হত্যা করতে দ্বিধা করে না।

যেমন ১. ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে ১৬০ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। ১৩টি মহিলা আসনের মধ্যে ৭টি লাভ করে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা হয় ১৬৭। পাকিস্তান সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আওয়ামী লীগার ও বাঙালি নিধনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কৈ, সেদিন তো আমেরিকা পাকিস্তানকে বলল না, জনগণ যাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। তারপরেও তারা নিরপেক্ষ থাকেনি। তারা পাকিস্তানের বর্বর সামরিক সরকারের পক্ষাবলম্বন করে, অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করে। আমেরিকার সমর্থন পেয়ে পাকিস্তান সামরিক সরকার হত্যাযজ্ঞে মত্ত হয়ে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করে। আমেরিকার সমর্থন না পেলে পাকিস্তান সরকার এতো বর্বর হতো না। সেদিন আমেরিকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কোথায় ছিল?

২. চিলির সালভেদর আলেন্দে ছিলেন তুখোর জনপ্রিয় কমিউনিস্ট নেতা। তিনি ১৯৫৩ সাল থেকে চিলির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৭০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বহু চেষ্টা করেন তাকে হারাতে। সেটি সম্ভব হয়নি। তখন নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রচেষ্টা চালান সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে। এ কাজে সিআই হাজার হাজার ডলার ঢালতে থাকে। তারা সেনা প্রধান স্নাইডার (Schneider)কে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে প্ররোচিত করেন। জেনারেল স্নাইডার চিলির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে রাজি হননি। তখন নিক্সন প্রশাসন সিআইকে নির্দেশ দেন স্নাইডারকে অপহরণ করে গুম করার এবং একজন ডানপন্থি জেনারেলকে বেছে নেওয়ার। সিআই এ কাজে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে দুটি গ্রুপকে রাজি করান। তারা জেনারেল স্নাইডারকে অপহরণ করতে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। ডানপন্থি সামরিক কর্মকর্তা পিনোচেটকে সেনাপ্রধান হিসেবে বসান। তিনি আলেন্দের বিরুদ্ধে ক্যু করতে রাজি হন। সিআই-এর প্রত্যক্ষ মদদে পিনোচেট প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে হত্যা করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। চিলির মতো একটা দেশে যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল, সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হয় স্বৈরতন্ত্র, গুম, হত্যা, দুর্নীতি। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কলকাঠি নেড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।

৩. ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘ তিন সদস্যবিশিষ্ট (ভারত, কানাডা ও পোল্যান্ড) আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠন করে এর অধীনে দুই বছরের মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ উভয় ভিয়েতনামে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। সে নির্বাচনের মাধ্যমে স্থির হবে ভিয়েতনামের ভাগ্য, কে ক্ষমতায় আসবে বা কোন ধরনের শাসন থাকবে। ১৯৫৬ সালে নির্বাচন হবে। হোচিমিনের বিপুল জনপ্রিয়তা। আমেরিকা মনে করল নির্বাচন হলে হোচিমিন জয়লাভ করবে এবং ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট ব্লকে চলে যাবে। তখন আমেরিকা সে নির্বাচনের সুযোগ না দিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামে ঘাঁটি গেড়ে বসে। ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামের শাসক বাওদাইকে সরিয়ে কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী দিয়েম নো নামক এক ক্যাথলিক যাজককে প্রেসিডেন্ট বানায়। শুরু হয় উত্তর ভিয়েতনামের সাথে যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ২০ লক্ষ ভিয়েতনামি মারা যায়, ৩০ লক্ষের অধিক আহত হয়, ১৫ লক্ষ লাওস ও কম্বোডিয়ার সাধারণ মানুষ মারা যায়। ৭ লক্ষ ভিয়েতনামি সেনা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। 

৪. ১৯৭৫ সালের ৬ ডিমসম্বর কিসিঞ্জার ইন্দোনেশিয়ার সামরিক শাসক সুহার্তোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতে তিনি সামরিক জান্তা সুহার্তোকে পূর্ব তিমুর অধিকারের সবুজসংকেত দেন। পরদিন ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী পাশ্ববর্তী দেশ পূর্ব তিমুর দখল করেন। পূর্ব তিমুরের লোকসংখ্যা ছিল ৬ লক্ষ। তারা দখলের বিরোধিতা করতে থাকে। ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী তাদেরকে পাইকারি হারে হত্যা করতে থাকে। এতে পূর্ব তিমুরের এক তৃতীয়াংশ (দুই লক্ষ) লোক মারা যায়। পূর্ব তিমুরের গণহত্যায় আমেরিকা খুশি হয়। এ অভিযানের পর  কিসিঞ্জার ইন্দোনেশিয়ায় অস্ত্র রপ্তানি এবং সামরিক সাহায্য দ্বিগুণ করার সুপারিশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ছিল প্রতিরক্ষা খাত ব্যতীত এ অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার সামরিক জান্তা সে অস্ত্র পূর্ব তিমুরের বিদ্রোহ ও আন্দোলন ঠেকাতে ব্যবহার করেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং সাহায্যের হাত আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। খাদ্য সহায়তার পিএল ৪৮০-এর তালিকায় বাংলাদেশের নাম কেটে ইন্দোনেশিয়ার নাম ঢুকানো হয়। তাই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সমর্থন না থাকলে ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুরে এতো বড় হত্যাযজ্ঞ চালাতে সাহস করত না।
পাঁচ. রাশিয়ার দখলকৃত ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া অঞ্চলে ২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গণভোট গ্রহণ করা হয়। উদ্দেশ্য এ অঞ্চলগুলো রাশিয়া ফেডারেশনে যোগ দেবে কিনা? গণভোটের ফলাফলে দেখা যায়, লুহানস্কের ৯৮৭ শতাংশের বেশি ভোটার রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। দোনেৎস্কের ক্ষেত্রে তা ৯৯ শতাংশের বেশি, খেরসনে ৮৭ শতাংশ এবং জাপোরিঝিয়ায় ৯৩ শতাংশ। ২০১৪ সালের ১১ মে দোনবাস (লুহানেস্ক ও দোনেস্ক) অঞ্চলে গণভোট হয়। তাতেও ৯৬.২ শতাংশ ভোটার রাশিয়া ফেডারেশনে যোগদানের পক্ষে রায় দেন এবং ৩.৮ শতাংশ ভোটার বিপক্ষে রায় দেন। তখন তো দোনবাস রাশিয়ার দখলে ছিল না। তারপরও তারা রাশিয়ার পক্ষে রায় দেন।

এ গণভোটের ফলাফল পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা মানে না। কারণ আর কিছুই না। এ রায় তাদের বিপক্ষে এবং তাদের শত্রু রাশিয়ার পক্ষে গিয়েছে। গণভোট নিয়ে সন্দেহ থাকলে জাতিসংঘের অধীনে পুনরায় ভোট নেওয়ার প্রস্তাব করতে পারে। তাও করে না। তারা কোনো গণভোট অনুষ্ঠানের পক্ষে নন। তারা বলেন, রাশিয়া ঐ অঞ্চল দখল করে চাপ সৃষ্টি করে তাদের পক্ষে রায় নিয়েছে। বাংলাদেশকে ভারত বা পাকিস্তান দখল করে গণভোটের আয়োজন করলে বাংলাদেশের মানুষ কি তাদের পক্ষে রায় দেবে? বিষয়টা কি এতো সহজ? দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের মানুষ রুশভাষী। তারা রুশ সংস্কৃতি, রুশ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তারা ইউক্রেনের শাসনাধীনে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে। সেখানকার ছেলেমেয়েদের রুশ ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। তাদের উপর ইউক্রেনীয় ভাষা চাপিয়ে দেয়া হয়। তারা ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়। এজন্য  ইউক্রেনীয় আজব নাৎসি বাহিনী হাজার হাজার বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যা করেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন স্বজাতি রুশভাষীদের উদ্ধার করতে সেখানে অভিযান চালিয়েছেন। এতে পুতিনে দোষ কী? কে কোন অঞ্চলে, কোন দেশে থাকতে চায়, সে অধিকার চাওয়া কি গণতন্ত্র পরিপন্থি? বলতে পারেন, পুতিন সেখানে যাবে কেন? পুতিন সেখানে না গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউক্রেনীয়রা সংখ্যা রুশদের মেরে ফেলে। রুশদের মেরে ফেললে পশ্চিমারা খুশি হয়। এ হলো তাদের গণতন্ত্রের নমুনা! 

২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে ১৬ মার্চ গণভোট দেয়। উক্ত গণভোটে ক্রিমিয়াবাসী রাশিয়ান ফেডারেশনে যোগ দেয়ার পক্ষে রায় দেন। পশ্চিমারা ক্রিমিয়ার গণভোটও মানে না। ক্রিমিয়া ছিল রাশিয়ার অংশ। ১৯৫৩ সালে প্রেসিডেন্ট ক্রুচেভ (Khruschev) ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করেন। তখন তো গণভোটের আয়োজন করে ক্রিমিয়াবাসীর মতামত নেওয়া হয়নি। সেটার বৈধতা নিয়ে পশ্চিমা কেন প্রশ্ন তোলেন না? ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালি হত্যা, ১৯৫৫-১৯৭৩ সালে মার্কিনিদের দ্বারা ভিয়েতনামীদের হত্যা, সত্তরের দশকে ইন্দোনেশীয়দের দ্বারা পূর্ব তিমুরীয়দের হত্যা ছিল পশ্চিমাদের চোখে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র। স্নায়ুযুদ্ধকালে আমেরিকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হত্যা, ক্যু ও সামরিক সামরিক শাসন জারি হয়। হত্যাকারীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া হয়। এগুলো হলো গণতন্ত্র! পশ্চিমারা আরেকটি কাজ করে। তাহলো নিজ খরচে মিডিয়া পোষে, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন গড়ে তোলে। এগুলোকে তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। পশ্চিমারা মহাপরাধ করলেও সেখানে এগুলো চুপ। পশ্চিমাবিরোধীদের বিরুদ্ধে এগুলো খুব সরব।

বাংলাদেশের স্বেচ্ছাচারী বাস মালিক সমিতি মাঝেমধ্যে কিছু অন্যায়-অযৌক্তিক দাবি করে। যেমন বিআরটিসি বাস বন্ধ করতে হবে। মালিক সমিতি বিআরটিসি বাসের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। আমেরিকা তদ্রুপ তার প্রতিপক্ষের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। সে নিষেধাজ্ঞা কেউ ভঙ্গ করলে তার উপর হামলা করে। কেউ আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করলে সে হয় বন্ধু। আর যদি কেউ রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করে সে হয় শত্রু। এটা কি গণতান্ত্রিক আচরণ? পাশ্চাত্যরা নিজ দেশে গণতান্ত্রিক হলেও বহির্দেশে এরা স্বৈরাচারী। মার্কিনিদের উত্তসূরি  ব্রিটিশরা একদিকে নিজ দেশে গণতন্ত্র চর্চা করেছে, অন্যদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জোর করে কলোনি স্থাপন করেছে। তাদের এ দ্বিমুখী আচরণ আজও বন্ধ হয়নি। 

লেখক : রেজাউল করিম, সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর

বাবু/জেএম

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত