জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছেড়ে আসা কিশোর ও তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে ক্যাম্প। সেখানে দৈনিক রুটিন করে সামরিক কায়দায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে কথিত হিজরতকারীদের। সারা দিন বিভিন্ন শারীরিক কসরত ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ চলছে। আর রাতে সংগঠনের বিভিন্ন সিনিয়র নেতারা জিহাদ সম্পর্কে বয়ান দিতেন। এসব বয়ানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীরা অল্প কিছু দিনের মধ্যে বুঝতে পারেন, শামীন মাহফুজ নামের একজন এই সংগঠনের প্রধান।
বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) রাজধানীর মিন্টু রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। তিনি জানান, বুধবার (২১ ডিসেম্বর) সিলেট থেকে সাইফুল ইসলাম তুহিন (২১) ও ঢাকা থেকে নাঈম হোসেনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। এরমধ্যে তুহিনের বাড়ি সিলেটে ও নাঈমের বাড়ি চাঁদপুরে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাহাড়ে অভিযান শুরু করলে কয়েকটি দলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার দুই সদস্য। পরে দলছুট হয়ে প্রায় এক মাস হেঁটে পাহাড় থেকে সমতলে আসে তারা। এই দুজন প্রায় এক বছর নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয়। সমতলে আসার পর গোয়েন্দা নজরদারিতে সিটিটিসি তাদের গ্রেফতার করে।
আসাদুজ্জামান বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিনের সাহায্যে নতুন জঙ্গি সংগঠন পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালায়। অভিযানের ফলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অভিযানে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির অনেক সদস্য গ্রেফতার হয়। অনেকে আবার গ্রুপে গ্রুপে পাহাড়ে অবস্থান নেয়। কেউ কেউ সমতল ভূমিতে ফিরে আসার চেষ্টা এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অনেকেই স্বেচ্ছায় গেছে। আবার অনেককে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়েও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ক্যাম্পে গিয়ে অনেকেই ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। সিলেট থেকে সাইফুল ইসলাম ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। সাইফুল ইসলাম একটি কওমি মাদ্রাসায় পড়তেন। সেখানে এক ইমামের মাধ্যমে তিনি উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। কথিত হিজরতে গিয়ে কী করতে হবে সেটি সাইফুল জানতেন না।
সিটিটিসি মহানগর প্রধান বলেন, ১৫ নভেম্বর সিলেট থেকে একটি মাইক্রোবাসে সাইফুলসহ তিন জন প্রথমে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তাদের আরও চার ‘হিজরতকারীর’ সঙ্গে দেখা হয়। সেখান থেকে তারা বাসে করে বান্দরবানের দিকে রওনা হন। রাস্তায় তাদের ফোন ও বাসা থেকে নিয়ে আসা টাকা নিয়ে নেয় সংগঠনটির এজেন্ট। এরই মাঝখানে তাদের চুল ও দাড়িও কেটে ফেলা হয়। পরে সাইফুল ইসলাম বান্দরবানে গিয়ে দেখেন তাদের সঙ্গে একই বাসে আরও ১০ জন ‘হিজরতকারী’ এসেছিলেন। বান্দরবান থেকে তারা থানচি যান। সেখান থেকে এক রাতে ১২ ঘণ্টা হেঁটে প্রথম প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছান।
ডিএমপির এই কর্মকর্তা জানান, মো. নাঈম হোসেন রাজধানীতে শেরেবাংলা কৃষি ইনস্টিটিউশনের চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। করোনার সময় ইনস্টিটিউশন বন্ধ থাকায় তিনি বাড়ি চলে যান। গ্রামের এক হুজুরের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন নাঈম। পরে তিনি ঢাকায় হলে চলে আসেন। হল থেকে সে কাউকে কিছু না বলে অক্টোবরের ২ তারিখে কুমিল্লায় সেফ হাউজে চলে যান। সেখান থেকে নাঈম একইভাবে আরও আট থেকে ১০ জনের সঙ্গে থানচি হয়ে পাহাড়ের প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌঁছান।
গ্রেফতার সাইফুল ও নাঈম জানান, ক্যাম্পের যেই কক্ষে শামীন মাহফুজ থাকতেন সেখানে সশস্ত্র পাহারায় থাকতো জঙ্গি সদস্যরা। কুকি-চিনের প্রধান নাথান বম মাঝে মধ্যে ক্যাম্পে এলে শুধু শামীন মাহফুজের কক্ষে গিয়ে আলোচনা করতেন। প্রথম ক্যাম্পটিতে সাত-আট দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শামীন সিদ্ধান্ত নেন, তারা মিজোরাম সীমান্ত লাগোয়া কোনও পাহাড়ে অথবা মিজোরামের ভেতরে কোথায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করবেন। কিন্তু সেখানে যেতে না পেরে তারা ফিরে আসেন। পরে তাদের ক্যাম্পে একবার হামলাও হয়। পার্বত্য এলাকার চরমপন্থি গ্রুপ জেএসএস (জনসংহতি সমিতি) এই ক্যাম্পকে কুকি-চিনের ক্যাম্প ভেবে এই হামলাও করে। পরে শামীন মাহফুজ সেখান থেকে আরেকটি পাহাড়ে গিয়ে দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি করেন।
আসাদুজ্জামান বলেন, এরই মধ্যে সাইফুল ইসলাম তুহিনসহ সিলেট থেকে আসা তিন জন এই প্রশিক্ষণের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বিদ্রোহ করেছিলেন। তারা সেখান থেকে ফেরত আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের বিদ্রোহের বিষয়টি টের পেয়ে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায় সংগঠনটির কমান্ডাররা। তাদের সারা দিন গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হতো, দোররা মারা হতো। একপর্যায়ে তারা নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে আবার সংগঠনের কার্যক্রমে ফেরত আসেন। তাদের দিয়ে সারা দিন ক্যাম্পের সব কাজ করানো হতো।
অক্টোবর মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যখন পাহাড়ের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অভিযান চালায় তখন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাইফুল ও নাঈম হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে একটি মার্মা গ্রামে গিয়ে ওঠেন। পরে ওই গ্রামের লোকজন তাদের ধরে কুকি-চিনের কাছে দিয়ে দেয়। কুকি-চিন তাদের পরিচয় জানতে পেরে এক মাস নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। শেষে তারা সূর্যের অবস্থান ও বাড়িঘর দেখে এক মাস হেঁটে বান্দরবান শহরে এসে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। নভেম্বরের ২৫ তারিখে তারা বান্দরবানে আসেন। এরইমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারিতে তাদের সন্ধান পায় সিটিটিসি।
গোয়েন্দা নজরদারির একপর্যায়ে সিলেট থেকে সাইফুল ইসলাম ও ঢাকা থেকে নাঈমকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের আদালতে রিমান্ড আবেদন করে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে এসব বিষয়ে আরও তথ্য জানা যাবে বলে জানান সিটিটিসির এই কর্মকর্তা।
বাবু/এসআর