আবাদ কম, উৎপাদন বেশি, ৩০০ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির সম্ভাবনা
মাহমুদ হাসান, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী)
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০২৩, ২:৩৬ PM
গরম যত বাড়ে তরমুজের চাহিদাও তত বাড়ে। গরমের উত্তাপ যত বেশি হয়, তরমুজের লাভও তত বেশি। সুস্বাদু ফল তরমুজের আবাদ করে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে এবার কারও মুখে হাঁসি ফুটেছে। আবার কারও মুখ হয়েছে মলিন।
তরমুজ চাষীরা বলছেন, বেড়িবাঁধের ভেতরে যারা তরমুজ আবাদ করেছেন, তাদের প্রায় চাষীই খেত রোগাক্রান্ত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু বাঁধের বাহিরে পলি জমা চরাঞ্চলের অনাবাদি জমিতে যারা তরমুজ আবাদ করেছেন, তাদের প্রায় চাষী লাভবান।
দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজ উৎপাদনে অন্যতম এলাকা হিসেবে পরিচিত ‘রাঙ্গাবালী’। তরমুজের বাড়িখ্যাত পটুয়াখালী জেলার এই দ্বীপ উপজেলার মাটি তরমুজ চাষের উপযোগী। তাই এখানকার তরমুজের গুণগতমান ভাল হওয়ায় দেশজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছে। চাহিদার পাশাপাশি লাভজনক ফল হওয়ায় নতুন নতুন চাষীও বাড়ছে এখানে। তবে একই জমিতে বার বার তরমুজ চাষে কমছে জমির উর্বরতা শক্তি; বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিলম্বে তরমুজ চাষে খেতে রোগব্যধি বাড়ছে। লবণাক্ত পানি, দিন ও রাতের তাপমাত্রা পরিবর্তন, রোগ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ঔষধের প্রয়োগ না হওয়া এবং জৈব সারের অভাব জনিত কারণে পাতা কুকড়ে ও গাছ মরে খেত হচ্ছে আক্রান্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষীরা।
গতবছর থেকে এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ায় এ বছর থেকে চরাঞ্চলের ফেলে রাখা নতুন নতুন জমিতে তরমুজ আবাদ শুরু করেছেন চাষীরা। এরফলে ভাল ফলনও পেয়েছেন তারা। উপজেলার কাউখালী চর, পাঙ্গাশিয়ার চর, চরনজির, চর ইমারশন, চর হেয়ার, চর তোজাম্মেল, লতার চরসহ বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা গেছে বিস্তীর্ণ খেতজুড়ে তরমুজের সমারোহ। যতদূর চোখ যায় শুধু তরমুজ আর তরমুজ। এই তরমুজ নিয়েই এখন চাষীদের স্বপ্ন আর ব্যস্ততা। কেউ পরিচর্যায় ব্যস্ত। কেউ ব্যস্ত পাকা ফল কাটায়। কেউ আবার পরিবহনে করে বাজারজাতে ব্যস্ত।
কথা হয় উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের পাঙ্গাশিয়া চরের তরুন তরমুজ চাষী মিথেল হাওলাদারের সঙ্গে (২৮)। তিনি বলেন, ‘চরের অনাবাদি জমিতে তরমুজ চাষ করে প্রায় চাষীই এবার লাভবান হয়েছে। এতে বেড়েছে চরের জমির দামও।’ আগামী বছর চরে তরমুজ আবাদ আরও বাড়বে বলে মনে করেন এই তরমুজ চাষী।
তরমুজ চাষীরা জানান, বেড়িবাঁধের ভেতরে ২০-২৫ বছর ধরে একই জমিতে তরমুজ আবাদ করেছেন, তাদের প্রায় চাষীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। উপজেলার চর মোন্তাজ ইউনিয়নের শিক্ষার্থী ও উদ্যোগক্তা রাসেল ফরাজী বলেন, ‘লেখাপড়ার পাশাপাশি তরমুজ চাষ করেছি। শুরুর দিকে ভাইরাসে গাছ আক্রান্ত হওয়ায় শঙ্কার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে এখন সফল। এ বছর ৩০ কানি জমিতে তরমুজ চাষ করেছি, বিক্রি হয়েছে প্রায় ৮০ লাখ টাকা।’
তরমুজ
এদিকে বাঁধের বাহিরে পলি জমা চরাঞ্চলের নতুন নতুন জমিতে যারা তরমুজ চাষ করেছেন, তারা প্রত্যেকেই লাভবান হয়েছেন; বলছেন তরমুজ চাষী ও ব্যবসায়ীরা। তরমুজ কিনতে আসা পাইকার শফিক উদ্দিন বলেন, ‘চরাঞ্চলে এবার তরমুজের ভাল ফলন হয়েছে।’ মাঠপর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, ‘আগামীতে চরের এক ইঞ্জি জমিও অনাবাদি থাকবে বলে মনে হয় না। একসময়ের ফেলে রাখা চরের জমিতে এখন সোনা ফলছে। ফলন ভাল হওয়ায় চাষীদের মুখে ফুঁটেছে হাঁসি।’
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় ৮ হাজার ২৬২ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ করা হয়েছে। তবে গতবছর পাতা কুকড়ে, গাছ মরে অজানা রোগে তরমুজ খেত আক্রান্ত হওয়ার কারণে এ বছর ১ হাজার ১৮৭ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ কম হয়েছে। তবে ফলন উৎপাদন ভাল হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ৩০ মেট্রিক টন ফল উৎপাদন হয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছেন, কোন প্রতিকূলতা না থাকলে ৩০০ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির আশা করছেন তারা।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘ইতোমধ্যে ৭৫ ভাগ খেতের তরমুজ বাজারজাত করা হয়েছে। বৃষ্টিবর্ষা কোন প্রতিকূলতা না থাকলে ৩০০ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।’ বেড়িবাঁধের ভেতরের জমিতে তরমুজ আবাদে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়েছে কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কৃষকদের প্রতি আমাদের পরামর্শ জমিতে জৈব সারের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। এক বা দুই বছর তরমুজ আবাদ বিরতিতে শষ্য পর্যায় হিসেবে লিগম (ডাল জাতীয়) ফসলের আবাদ করা প্রয়োজন। এতে নাইট্রোজেন মাটিতে সংরক্ষণ করে এবং জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। এছাড়া অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে তরমুজ বীজ বপন করলে ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে।’