দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিউক্লিয়ার প্রটেকশন ফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বিশেষায়িত এ ফোর্সটি এখনো জনসম্মুখে আত্নপ্রকাশ করেনি। তবে উন্নত প্রশিক্ষণ শেষ করেছে। আগামী অক্টোবরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়াম আসবে। বিশেষায়িত এ ফোর্সটি নিরাপত্তা দিয়ে সেই ইউরেনিয়াম নিয়ে যাবে রূপপুরে। এর ম্যাধমে জনসম্মুখে আত্নপ্রকাশ ঘটবে ফোর্সটির। আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২ অক্টোবরে রূপপুরে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে সেখানে নিরাপত্তায় কাজ করছে সেনাবাহিনী। কিন্তু সময় যত গড়ায় এর কাজের অগ্রগতিও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় বিশেষায়িত ফোর্সের প্রয়োজন হয়। আর সেটির নিরিখে ২০২০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রায় ২ বছর রাশিয়া থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়ে পরিপূর্ণ নিউক্লয়িার প্রটেকশন ফোর্স গঠন করে। এ ফোর্সের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। ফোর্সের জন্য উন্নত গিয়ার্সও কেনা হয়েছে।
সূত্র জানায়, যেহেতু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প সেহেতু এর নিরাপত্তাও থাকবে কঠোর। নিউক্লিয়ার প্রটেকশন ফোর্সের কাজ হবে ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। নিরাপত্তার কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আকাশ পথে নিরাপত্তা, যে কোনো সন্ত্রাসী হামলা রুখে দেয়া এবং দেশে আসা ইউরেনিয়াম যথাযথ নিরাপত্তা দিয়ে সেগুলো রূপপুরে পৌঁছে দেয়া।
সূত্র জানায়, আগামী অক্টোবরে দেশে এসে পৌঁছাবে ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে বিশেষ নিরাপত্তায় ইউরেনিয়াম নিয়ে রাখা হবে রূপপুরের ফুয়েল স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিতে। ইউরেনিয়াম পরিবহন থেকে শুরু করে ফুয়েল স্টোরেজ ফ্যাসিলিটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে এই প্রোটেকশন ফোর্স।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হবে ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি)। এই প্রকল্পের ৯০ শতাংশ টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। একই সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রুশ ঠিকাদার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি এটি পরিচালনার জন্য জনবল প্রশিক্ষণও দিচ্ছে রাশিয়া।
প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, করোনা পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এই প্রকল্পে এখনো পড়েনি। ২০২৩ সালের শেষ দিকে প্রথম ইউনিটের কাজ শেষ হবে। এরপর কমিশনিং শুরু হবে।
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত প্রথম ইউনিটের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আর পুরো বিদ্যুৎ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৫৫ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ৫৩ শতাংশ। ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শেষ হবে।
পারমাণবিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের রি-অ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল (পারমাণবিক চুল্লি পাত্র) বসে গতবছরের ১৯ অক্টোবর। এটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে মূল জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) থাকবে। এটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হৃৎপিণ্ড হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট। রূপপুরের বিদ্যুৎ যুক্ত হলে উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ২৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। তখন দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সাড়ে ৯ শতাংশই যাবে রূপপুর থেকে।
বর্তমান সময়ের কথা চিন্তা করে রাশিয়ার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, আর্থিক ও প্রকল্প বাস্তবায়নসহ সার্বিক সহযোগিতায় নির্মিত হচ্ছে দেশের ইতিহাসের সর্ববৃহত এ প্রকল্প। এতে স্থাপন করা হচ্ছে রাশিয়ার উদ্ভাবিত সর্বশেষ প্রযুক্তি থ্রিজি (প্লাস) ভিভিইআর ১২০০ মডেলের রি-অ্যাক্টর। রোসাটম প্রকৌশল শাখা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে ৩৩ হাজার লোক। তার মধ্যে বিদেশি রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার।
বাঙালির অনন্য এক অর্জন রূপপুর
রাজধানী ঢাকা থেকে দুইশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে-পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত রূপপুর। এই এলাকাতে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের বসতি রয়েছে। ১৯১৫ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ পদ্মা তীরের ওই জনপদে একটি রেল সেতু নির্মাণ করেন। যার নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। তখন থেকেই এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে আসছে এ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। দীর্ঘকাল পর-পদ্মা তীরের ওই জনপদে আবারও উন্নয়ন ও অগ্রগতির বারতা নিয়ে নির্মিত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে নতুন এক দুয়ার খুলে যাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ ও বাঙালির অর্জন অনেক-পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মেট্রোরেল, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, পরমাণু বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রভৃতি। বস্তুত এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় অনন্য এক মাইলফলক। কারণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন উচ্চতর ও সংবেদনশীল প্রযুক্তিঘন এক কর্মযজ্ঞ।
এদিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় আমাদের কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা না-থাকলেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় রাশিয়া সকল ধরনের সহযোগীতা করছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, মূল্যসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ প্রাপ্তিই শুধু নিশ্চিত হবে না, বরং এর মাধ্যমে দেশে পারমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় দক্ষ জনবল গড়ে উঠেছে। যারা বিশ্ব নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে অবদান রাখার মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে। যার ফলে আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে বৈকি। অধিকন্তু বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।
স্বল্প আয়তনের ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসাবে বাংলাদেশ টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক উৎসের ওপর নির্ভর করা অনেকাংশেই সমীচীন। কারণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল সাধারণত ষাট বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। পরে তা আশি বছর পর্যন্ত বাড়ানো যায়। সেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ পঁচিশ বছর হয়ে থাকে। তাই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ব্যয় প্রাথমিকভাবে বেশি হলেও দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে সাশ্রয়ী মূল্যে এ কেন্দ্র থেকে জনগণ বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে।
এদিকে ফুয়েল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনেক সাশ্রয়ী। যেমন একগ্রাম ইউরেনিয়াম ব্যবহারে প্রায় চব্বিশ হাজার কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। অন্যদিকে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে তিন টন কয়লার প্রয়োজন হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন হচ্ছে সে পরিমাণ স্থানে আমরা যদি সৌর প্যানেল বসাই, তাহলে মাত্র আট মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুতের যুগে যে পদার্পণ, তা ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়ন তথা উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে শামিল হওয়ার পথযাত্রাকে বেগবান করবে।
-বাবু/এ.এস