শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৩ বৈশাখ ১৪৩২
শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫
চিনির পর এবার তেলের দাম নিয়ে তেলেসমাতি
কামরুজ্জামান রনি, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: শনিবার, ৬ মে, ২০২৩, ৪:২৭ PM

সরকারের বেঁধে দেয়া দরের চেয়ে বাড়তি দরে চিনি বিকিকিনির পর এবার তেল নিয়ে তেলেসমাতি শুরু করছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী৷ ইতিপূর্বে তেল আমদানিতে সরকারের ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে ভোজ্যতেলের দাম। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে উর্ধ্বমুখী অপরিশোধিত চিনির দাম। যদিও রমজান মাসে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে বিপুল পরিমান চিনি আমদানি করা হয়েছে। দেশের আমদানি তথ্য বলছে বর্তমানে দেশে চিনির যথেষ্ট মজুত রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বাড়ার সাথে সাথেই বাংলাদেশের বাজারে পরিশোধিত চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে চিনি উৎপাদনকারীরা। এতে করে চিনির বাজার দরের উর্ধ্বমূখি প্রবণতা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে বলে ধারনা করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। ফলে দেশের ভোগ্য পণ্যের বাজারে চিনি ও ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে৷ যদিও বাজার তদারককারী একাধিক সংস্থা বলছেন তারা বাজার মনিটরিং আরো জোরদার করবেন।

এপ্রিল মাসের ৮ তারিখ সরকার খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করে দেয় ১০৪ টাকা আর প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনির দাম ধার্য্য করা হয় ১০৯ টাকা। এপ্রিল মাসের শেষ দিন পর্যন্ত চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে প্রতিকেজী খোলাবাজারে প্রতিকেজী চিনি বিক্রি দর গিয়ে ঠেকেছিল ১১৮ থেকে ১২৫ টাকা পর্যন্ত৷ রমজানের ঈদের কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে চট্টগ্রামের বাজার থেকে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের প্যাকেটজাত চিনি উধাও হয়ে যায়। খুচনা দোকান গুলোর পাশাপাশি নামি দামি সুপার সপ গুলোতে পর্যন্ত প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যায়নি।

রমজানের ঈদের আগের দিনে চট্টগ্রামের পাইকারী বাজারে (খাতুনগঞ্জ) প্রতি মণ চিনির দাম সর্বোচ্চ তিন হাজার ৮৫০ টাকায় পৌছে। তবে চলতি মাসের শুরুর দিন থেকেই অস্বাভাবিক হারে দফায় দফায় বাড়ছে চিনির দাম৷ গেল সপ্তাহে প্রতিমন চিনি ৪ হাজার ৬৩৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে ২০ লাখ টনের মতো চিনির চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদিত চিনির পরিমান ২৬ থেকে ৩২ হাজার টন৷ । যেখানে প্রতি মাসে দেড় লাখ টনের বেশি চিনির চাহিদা সেখানে দেশের সর্বমোট উৎপাদন দিয়ে এক সপ্তাহের চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশের চিনির বাজার পুরোটাই আমদানি নির্ভর। তবে বর্তমানে দেশের একাধিক শিল্প গ্রুপের কারখানা গুলো অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধনের মাধ্যমে দেশের চাহিদার সবটুকু চিনি উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এই মূহুর্তে দেশে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ ও আবদুল মোনেম লিমিটেড আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপরিশোধিত চিনি এনে পরিশোধনের পর বাজারজাত করে। এছাড়া আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এসব চিনি নিজ নিজ ব্রান্ডে প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করছে। তবে মূলত ৫ শীর্ষ গ্রুপের হাতেই রয়েছে দেশের আমদানিকৃত চিনির বাজার। ঈদের বন্ধের অজুহাতে বর্তমানে এসব কারখানা গুলো থেকে পাইকারি বাজারে সরবরাহ কমে গেছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারীরা। প্রতিষ্ঠান গুলোর ডিলাররাও এই বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হয়নি।

এই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনির দাম ৬৭৫ মার্কিন ডলার। যা এক মাস আগেও যা ছিল ৫২০ মার্কিন ডলার। আমদানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দামে চিনি আমদানি করে পরিশোধন ও শুল্কায়নের খরচ যোগ হলে বাজারে কেজি চিনির দাম পরবে ১৩১ টাকা। এই পরিস্থিতিতে দেশের চিনি আমদানিকারক ও চিনি পরিশোধনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন এই দরে চিনি আমদানি করবে কি না সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চেয়ে চিঠি দিয়েছে । গত ২ মে সংগঠনটির মহাসচিব গোলাম রহমানের সই করা এক চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়।

তবে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়েছে এটা সত্যি তবে এই বাড়তি দরের চিনি আমদানি করে দেশে পৌছতে আরো অনেক সময় লাগবে। দেশে বর্তমানে মজুত চিনি গুলো পূর্বের কম দামেই কেনা।

কনিজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহ-সভাপতি এস. এম নাজের হোসেন বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, দূর্ভাগ্যজনক ভাবে বিদেশে যে কোন আমদানি নির্ভর ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথেই আমাদের দেশে সেদিনই দাম বেড়ে যায় অথচ একই পণ্যের দাম যখন আন্তর্জাতিক বাজারে হ্রাস পায় তখন কিন্তু মজুদের অজুহাতে দাম কমানোর নজির নেই। বর্তমানে পূর্বের দামে আমদানি করা চিনির পর্যাপ্ত থাকার পরো দাম বাড়ানোর পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে এখন বাজারে চিনি সরবরাহ কমে গেছে। এস.এম নাজের আরো বলেন, দেশে পর্যাপ্ত চিনির মজুদ থাকার পর এভাবে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর কৌশল নতুন কিছু নয়। দেশে এখন পর্যন্ত কি পরিমান চিনি আমদানি করা হয়েছে সেই তথ্য সরকারের কাছে অবশ্যই রয়েছে৷ সুতরাং চাহিদা ও সরবরাহের হিসেব করে দেখলে সহজেই মজুদের পরিমান জানা যাবে৷ তাই এখনই সরকারের উচিত দেশের বৃহত আমদানিকারকদের গুদামে অভিযানে নামা। তবে রহস্যজনক কারণে এসব অভিযান গুলো শুরু হতে হতেই থেমে যায় বলে মন্তব্য করেন এই ক্যাব নেতা।

তবে দেশের অন্যতম শীর্ষ একাধিক চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের দ্বায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে , চিনি আমদানি মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান একাই প্রতি মাসে দুই জাহাজে গড়ে এক লাখ টন করে চিনি আমদানি করছে।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে,  এখন (৪ মে) চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মেঘনা গ্রুপের একটি জাহাজ থেকে চিনি খালাস করা হচ্ছে। ওই জাহাজে প্রায় ৬০ হাজার টন চিনি রয়েছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ। কাস্টমস হাউজ সূত্র বলছে চলতি বছর রমজানকে সামনে রেখে ২৬ ফেব্রুয়ারি চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ শুল্ক চিনির ওপর শুল্ক ৫ শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। শুল্ক হ্রাসের এই সুবিধা চলতি নে মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত বলবৎ থাকাবে বলে।

ভোগ্যপণ্যের একাধিক পাইকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে মিল গেইট থেকেই চিনি বিক্রি হচ্ছেনা।  এই অবস্থায় আমরা বাড়তি দরে চিনি কিনে কম দামে বিক্রি করার সুযোগ নেই৷ এদিকে জরিমানার ভয়ে খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে চিনি বিক্রি নিয়ে লুকোচুরি খেলা শুরু হয়েছে৷ একাধিক বাজার ঘুরে বেশীর ভাগ দোকানে চিনি নেই বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে দোকানীরা। তবে পূর্ব পরিচিত এবং বেশী দামে চিনি কিনতে আগ্রহীদের ঠিকই চিনি বিক্রি করা হচ্ছে৷ এক খুচরা বিক্রেতা জানান, সরকারী দামে আমরা তো দূরের কথা পাইকাররাও কিনতে পারে নাই৷ পাইকারি বাজার থেকে চিনি কিনে সেই চিনি পরিবহন, দোকান খরচ যোগ করলে বিক্রয় মূল্য অনেক বেড়ে যায় ফলে পারত পক্ষে চিনি বিক্রিতে আগ্রহী নন তারা৷ এর কারণ হিসেবে বাজার মনিটরিং টিমের জরিমানার আতংকের বিষয়টি স্বিকার করেন।

বাজারে চিনি নিয়ে চলমান অস্থিরতার মধ্যে ভোজ্যতেলের বাজারেও অস্থিরতার আভাস মিলছে। মূলত ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাট কমানোর মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল ব্যবসায়ীরা। তবে এনবিআর বলছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় দেশের বাজার দার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত বছরের ১৬ মার্চ ভোজ্যতেলের ভ্যাট আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর পর একই অজুহাতে কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পর চলতি বছর ৩০ এপ্রিলে ভ্যাট মওকুফের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এছাড়া এতদিন আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশের পরিবর্তে মাত্র পাঁচ শতাংশ হারে কার্যকর ছিল। তবে যা এখন আবারও ১৫ শতাংশে ফিরে গেল।

গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে চট্টগ্রামের বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের তেলের দাম এক লাফে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। এই দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৬ টাকা; যা পূর্বে ছিল ১৬৭ টাকা। এছাড়া পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৯০৬ টাকা থেকে ৫৪ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৬০ টাকা। এছাড়া খোলা পাম সুপার তেল লিটার প্রতি ১১৭ টাকা থেকে ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে সংগঠনটির নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম মোল্লার সই করা বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

যদিও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আরো আগে থেকেই সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরেজমিন দেশের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ঈদের আগে থেকেই সয়াবিন তেল মণ প্রতি ছয় হাজার ২০০ টাকা থেকে ৬ হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।  যা প্রতিদিন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গত সপ্তাহান্তে এসে বিক্রি হয়েছে ছয় হাজার ৮০০ টাকায়।

একইভাবে ১০ দিন আগে পাম তেল বিক্রি হয়েছে মণ প্রতি চার হাজার ৫২০ টাকা করে। বুধবার বিক্রি হয়েছে চার হাজার ৯৪০ টাকায় ও আজ (বৃহস্পতিবার) বিক্রি হচ্ছে চার হাজার ৯৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। ১০ দিন আগে প্রতি মণ পাম সুপার তেলের দাম ছিল চার হাজার ৭০০ টাকা। বুধবার বিক্রি হয়েছে পাঁচ হাজার ১০০ টাকায় ও আজ বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ১৪০ টাকায়।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মাহবুব আলম বাংলাদেশ বুলেটিনকে জানান, আমাদের দেশে চিনি ও ভোজ্যতেল আমদানি নির্ভর৷ আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেশি, ভোজ্যতেলের দামও উর্ধ্বমূখি দিকে। এই কারণে দেশেও এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। তেলের দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়েছে।

চিনি, তেল সহ সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে মনিটরিং জোরদার করা হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। তবে সাধারণ ভোক্তাদের মতে, গুটি কয়েক উৎপাদককে কঠোর মনিটরিং এ রাখা হলে সারা দেশের বাজার ঘুরে মনিটরিং এর দরকার পড়ে না৷ এসব অভিযানে সামান্য কিছু ব্যবসায়ী শাস্তি পেলেও ভোক্তাদের পকেট থেকে পরবর্তিতে সেই টাকা আদায় করে নেয় কতিপয় ব্যবসায়ীরা।

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত