রাজধানী ঢাকার রাস্তায় যানজটের কারণে চলাই দায় হয়ে পরেছে। তীব্র যানজটে নাকাল মানুষ। প্রশ্ন হলো উড়াল সেতু মেট্রোরেল, পাতাল সড়ক একের পর এক হচ্ছে যানজট কমছে না কেন? এত অর্থ ব্যয়ের পরও যানজট মুক্ত হচ্ছে না কেন ঢাকা? সড়ক আইন অনেকেই মানছে না। সড়ক আইন মানতে বাধ্যও করছেনা সরকার। আইনের শাসন না থাকায় যে যার মতো চলছে সড়কে। আর তাতে যানজট হচ্ছে। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এসব মেগাপ্রকল্পগুলো যানজট কমানোর জন্য স্বার্থেই হয়েছে। জনগণের কল্যাণেই সরকার তা করেছে। কিন্তু আইন না মানায় রাষ্ট্রের এতো ব্যয় বোধ করি জলেই যাচ্ছে।
রাজধানীতে এমন ফ্লাইওভার হবে, পাতাল সড়ক হবে, মেট্রোরেলে আমরা চড়বো ভাবিনি কখনো। তা কিন্তু হয়েছে এবং ভালো মানের। আমাদের মেট্রোরোলের গুণগতমান ভারতের চেয়েও উন্নত। অথচ এদেশের কিছু অসৎ মানুষ কু-বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজেদের কামাই বাড়ানোর জন্য এসবের সুফল প্রাপ্তি ম্লান কওে চলেছে। মানবসৃষ্ট যানজটে ঢাকার সড়কের বারোটা বাজছে। এদের হাত থেকে সড়ক, ফুটপাত দখলমুক্ত করা গেলে তবেই যানজট মুক্ত করতে হবে ঢাকা।
ঢাকার রাস্তায় এত ট্র্যাফিক জ্যাম কেন? আর এর সমাধানই বা কী? সমাধান আছে! আমাদের অর্থাৎ জনগণ, পরিবহন চালক, ট্রাফিক আর পুলিশ প্রশাসনকে ভালো হয়ে যেতে হবে। আমাদের সভ্য হতে হবে। সড়ক সংশ্লিষ্টদের আইনের যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যেদিন জনগণ রাস্তার আইন মানবে, ট্রাফিক পুলিশ ঘুষ না খেয়ে রাস্তায় ঠিকঠাক যানজট কমানোর কাজ করবে, চালকগণ ট্রাফিক নিয়ম মেনে রাস্তায় পরিবহন চালাবে, ফুটপাতে দোকানদারি বন্ধ হবে সেদিনই রাজধানী ঢাকার যানজট কমে আসবে। ঢাকা থেকে ছোট যানবাহন কমাতে হবে, সর্বোপরি সরকার সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।
ঢাকা এখন যানজটের শীর্ষে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার করেও রাজধানীর প্রবেশ মুখ যাত্রাবাড়িতে বারো মাসই যানজট লেগে থাকে। গুলিস্তানের যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ। প্রায়ই ফ্লাইওভারে যানজট থাকে। বাড্ডায় ইউলুপ তৈরি হলো রামপুরা, বাড্ডা, এয়ারপোর্টে যানজট কমানোর জন্য। সেখানেও বারো মাস যানজট থাকে। নানামুখী সমস্যায় ঢাকা মহানগরের জীবনযাত্রা ক্রমেই আরও বেশি মাত্রায় দুর্ভোগময় হয়ে উঠছে। সবচেয়ে প্রকট ও জটিল সমস্যা হলো এই যানজট।
বিশে^ সর্বাধিক যানজটের শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ঢাকা। ঢাকায় বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতিতে গাড়ি চলে। ঢাকা মহানগরের যানজট অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভারগুলো চালুও হলে ঢাকার যানজট অনেকটাই কমে যাবে এমনটাই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু গোড়ায় গলদ আছে। যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কথায় ধরুন। ফ্লাইওভারের নিচে সবসময় যানজট থাকে। সেই যানজট ফ্লাইওভারে গিয়ে ঠেকে। ফ্লাইওভারেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটেকে থাকে যানবাহন। সংশ্লিষ্টরা কারণ খুঁজতে গিয়েছেন কি কখনো? টোল দিয়ে যেন পরিবহন ফ্লাইওভারে ওঠে এর জন্য মানবসৃষ্ট যানজট তৈরি করা হয় সেখানে। কীভাবে?
ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা বারো মাসই ভাঙাচোরা থাকে। এভাবে ভাঙাচোরা রাখা হয় কি না তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্রের। দেশের সব রাস্তাঘাট উন্নত হয়, আর রাজধানীর প্রবেশমুখের এই সামান্য রাস্তাটুকুর এই বেহাল অবস্থা কেন? যানজটের ভয়ে পরিবহনগুলো যেন ফ্লাইওভাওে টোল দিয়ে যাতায়াত করে এজন্য? হয়তো, হয়তো না। প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্টরা যদি কিছু পেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখে তাহলে কী হবে? তাছাড়া রাজধানীর প্রবেশ মুখে বিশাল পাইকারি বাজারও যানজটের কারণ হচ্ছে। বাজার সরিয়ে নেওয়ার কথা শুনছি বহুদিন ধরে। সরছে না বিশেষ কারণে। ব্যক্তিস্বার্থ আছে তাই নাকি যানজট সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখা বাজার সরানো হচ্ছে না।
কথিত আছে কখনো কখনো নাকি যারা ভূত তাড়ায়, তার ভেতরেই নাকি ভূত থাকে। কী সেই ভূত? অনেক সময় নাকি যারা রাস্তা যানজটমুক্ত করবেন তারাই নাকি যানজটের কারণ হন। এটা করতে যাবেন কেন উনারা? কারণ কিছু আয়। খালি পকেটভর্তি করতেই নাকি এই আয়োজন চলে কোথাও কোথাও। ঢাকার ডেমরা রাস্তাগুলোয় যানজট থাকলে নাকি পরিবহনের কাগজ পরীক্ষার নামে ভালো ঘুষবাণিজ্য চালানো যায়। কাগজপত্র ঠিক না থাকলে তো কথা নেই। তাও টাকা দিতে হয়। পরিবহনের কাগজ সব ঠিকঠাক থাকলে সমস্যার আর শেষ নেই। গাড়িতে ঘষা লেগেছে কেন? নেমপ্লেটের রং জ্বলে গেছে দেখা যায় না কেন? নানান সব বাহানা।
বাড্ডা ইউলুপ হলো, প্ল্যানিং সঠিকই আছে। সেখানে যানজট কমার কথা। কমছে না কেন? হাতিরঝিলের গুলশান প্রবেশমুখ থেকে আসা সড়ক যেটা বাড্ডা সড়কে যুক্ত হয়েছে সেখানে একটা গ্যাস পাম্প আছে। পাম্পের গাড়ি রাস্তায় লাইন ধওে দাঁড়িয়ে থাকে। গুলশান থেকে ঢুকতে আর রামপুরা থেকে যে গাড়ি আসে সেখানে এসে আটকে যায়। ইউলুপ চালুর সময় জানতাম যানজট কমানোর স্বার্থে পাম্প নাকি সরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু হয়নি। ঐ যে বিশেষ ব্যক্তি, তাই পাম্প যথাস্থানেই আছে। যতই যানজট হোক, এটা নড়ানোর কারো ক্ষমতা নেই কারো।
রাজধানীর আরেক প্রবেশমুখ শীতলক্ষ্যা সুলতানা কামাল সেতুর ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টারে নিত্য চলে ট্রাফিক পুলিশের খেলা। তাই সেখানে যানজটও নিত্য। রাস্তা ফাঁকা থাকলে এই বাণিজ্য জমে না তাই নাকি ট্রাফিক পুলিশই নানা অজুহাতে যানজট তৈরি করে সেখানে। এমন অভিযোগ স্থানীয় সাংবাদিক এবং ব্যবসায়ী মহলের। এমনটা করা হচ্ছে রাজধানীর প্রবেশ মুখ টঙ্গি, গাবতলী, সাভারে। এসব প্রবেশদ্বারে যানজট তৈরি হলে রাজধানীর ভেতরের সড়কগুলো যানজট হবে এটাই স্বাভাবিক।
রাজধানীর অভ্যন্তরে কথিত পার্কিং বাণিজ্য, ট্রাফিক পুলিশের র্যাকার বাণিজ্য চলতে থাকলে যতই ফ্লাইওভার আর মেট্রোরেল কিংবা পাতাল সেতু চলুক ঢাকায়; যানজট কমবে না। ঢাকায় কি ফুটপাত আছে? থাকলেও ওগুলো চাঁদাবাজদেও পকেটের খোরাক তৈরির জন্য দখল হয়ে থাকে সবসময়। কত না অসভ্য আমরা। একটা ফুটপাতের দু’ধারেই অবৈধ দোকান বসানো হয়। ফলে মানুষ ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে পারে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটে মানুষ। গুলিস্তান, মতিঝিল, দিলকুশা, শান্তিনগর এমনকি গুলশান, বনানীর অনেক সড়ক এখন হকারদের দখলে। অবশ্য হকাররা দ্বিতীয় দখলদার। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কথিত লিজ নিয়ে হকারদেও ফুটপাত ভাড়া দেয়। এটা বাংলাদেশেই সম্ভব।
মানুষ রাজধানীর সড়কে ঠিকমতো হেঁটেও চলতে পারছে না। যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ। এই শহরে এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন। যানবাহনের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
রাজধানীর যানজট সহনীয় মাত্রায় আনতে স্বল্পগতির যানবাহন ও প্রাইভেট কারের সংখ্যাধিক্যের দিকে নজর দেওয়া দরকার। ট্রাফিক আইন যাতে সব ক্ষেত্রে কড়াকড়িভাবে মানা হয় সেই ব্যাপারেও যত্নবান হতে হবে। ফুটপাত থেকে দোকানপাট উঠিয়ে দেওয়া, যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং দিনের ব্যস্ত সময়ে প্রাইভেট কার চলাচল কমিয়ে আনার কথাও ভাবতে হবে। স্বল্পগতির রিকশা ও প্রাইভেট কারের আধিক্য কমাতে হবে।
এবার প্রাইভেট কার, রিকশা, বেবিট্যাক্সিসহ বিভিন্ন পরিবহনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। মতিঝিলকে বাণিজ্যিক জোন ঘোষণা করে বাস ছাড়া সব পরিবহন বন্ধ করে দিতে হবে। এই দুঃসহ যানজট থেকে ঢাকাবাসীকে মুক্ত করতেই হবে। এজন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা আর আইনের প্রয়োগ। সরকার এই ব্যাপারে সচেষ্ট হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : চেয়ারম্যান, আল-রাফি হাসপাতাল লি.
-বাবু/এ.এস