শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ১২ বৈশাখ ১৪৩২
শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫
সময়োপযোগী আশাবাদী বাজেট
ড. আতিউর রহমান
প্রকাশ: রবিবার, ৪ জুন, ২০২৩, ২:৪৯ PM

বাজেট তো কেবল সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়; বরং একটি রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক দলিল, যা একই সঙ্গে চলতি বছরের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অর্জনের দলিল এবং সরকারি, অ-সরকারি ও ব্যক্তি খাতের সব অংশীজনের জন্য আসন্ন অর্থবছরের পথনকশা। সে বিচারে গত ১ জুন বৃহস্পতিবার মহান জাতীয় সংসদে যে বাজেট প্রস্তাব করা হলো, তা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ একদিকে ছিল ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে সৃষ্ট সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে সংকোচনমুখী বাজেট তৈরির চাপ, অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জনতুষ্টিবাদী কর্মসূচি ও উদ্যোগে বরাদ্দ দেওয়ার তাগিদও ছিল।
প্রাথমিকভাবে বাজেট ডকুমেন্টগুলো দেখে মনে হচ্ছে নির্বাচনমুখী জনতুষ্টিবাদ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই এ বাজেটের মূল লক্ষ্য। তাই বাজেটটিকে প্রাথমিকভাবে সময়োপযোগীই বলব। সংস্কারধর্মী ও সুদূরপ্রসারী বললেও ভুল হবে না। একই সঙ্গে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটটিকে আশাবাদীও বলা যায়। কেননা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখেও উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড থেকে খুব বেশি পিছু হটেননি আমাদের বাজেট প্রণেতারা।

তাই প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়ানো হয়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। এটাকে উচ্চাভিলাষী বলাটা ঠিক হবে না। কেননা বাজেটে সরকারের আয় বৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে, তা অর্জন করা গেলে এ বাজেট বাস্তবায়নের অর্থ সরবরাহ নিয়ে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণ ও সহযোগিতা ছাড়াও আসছে অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের জন্য চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

চলতি বছরের সংশোধিতার তুলনায় এই লক্ষ্যমাত্রা ১৬.২২ শতাংশ বেশি। বাজেট বক্তৃতাসহ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিভিন্ন বক্তব্য থেকে যতটা জানা গেছে, তাতে মনে হয় কর প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে এই তুলনামূলক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সে জন্য রাজস্ব সংগ্রহকারী সংস্থার ডিজিটাইজেশন ও সংস্কারের প্রয়োজনীয় অঙ্গীকারও করা হয়েছে। আর সেটিই ছিল কাম্য। ন্যূনতম করসীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়ালেও ৪০টি সেবার জন্য করসীমার নিচের মানুষেরও দুই হাজার টাকা গুনতে হবে।

যদি ডিজিটাল ব্যবস্থায় এই ন্যূনতম কর দেওয়া যায় এবং সার্টিফিকেট মেলে, তাহলে সাধারণ মানুষের হয়রানি কমবে এবং কর কাঠামোতে অংশগ্রহণ বাড়বে। তবে করপ্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বৃহত্তর নাগরিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে বলে আমি মনে করি। যথাযথভাবে কর দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে একটি সামাজিক আন্দোলন সরকারের প্রচেষ্টার যথাযথ সম্পূরক হয়ে উঠতে পারে।

সময়োপযোগী আশাবাদী বাজেটকয়েক মাস ধরেই বাজেটে মূল্যস্ফীতির প্রক্ষেপণ নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বাজেট প্রস্তাবে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ প্রক্ষেপিত হয়েছে। এটা করা গেলে তা সবার জন্যই মঙ্গলজনক। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস শেষে গড় মূল্যস্ফীতি কিন্তু ৮ শতাংশের বেশি। তাই ৬.৫ শতাংশে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা বেশ কঠিন হবে বলেই আমার ধারণা। একই সঙ্গে পাঠকদের এ কথাটিও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, গত এক বছরে বিশ্ব পণ্যবাজারে দাম ৪৩ শতাংশ কমেছে। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতিও যেহেতু মূলত আমদানিজনিত, তাই মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্যটিকে অবাস্তব বলছি না। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং মূলত মুদ্রানীতির আওতায় পড়ে। সে জন্য তাকে নিঃসন্দেহে রক্ষণশীল ও বাজারনির্ভর হতেই হবে। তবে এই মধ্যবর্তী সময়ে কম আয়ের পরিবারগুলোকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থাও দরকার। বাজেটে তাই সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দও যতট সম্ভব বাড়ানোর উদ্যোগ দৃশ্যমান। অনেক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও দেয় ভাতা বা সুবিধা বাড়ানো হলেও অনেকে বলছেন, এ বাবদ আসছে বছরের জন্য বরাদ্দ প্রয়োজনের চেয়ে বেশ খানিকটা কম হয়েছে। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি (যা সংশোধিত মোট বাজেটের প্রায় ১৮ শতাংশ)। আসছে বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি হলেও বাজেটের শতাংশ হিসাবে কমে ১৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

আমার মনে হয়, আরো নতুন নতুন কর্মসূচি নেওয়া গেলে এবং বিদ্যমান কর্মসূচিগুলোর আওতায় দেয় সহায়তার পরিমাণ আরো বাড়ানো গেলে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ খানিকটা স্বস্তি পেত। তবে আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের দিক থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকা সত্ত্বেও আসছে অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ৮৪ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এটিকে জনস্বার্থের প্রতি নীতি-সংবেদনশীলতা হিসেবেই দেখি। অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও মনে হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর বাস্তবায়ন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখে বাজেট প্রণেতারা সেদিকে হাঁটেননি। তবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মানবপুঁজির বিকাশের কোনো বিকল্পও নেই।

প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় দুই লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। আশার কথা এই যে ঘাটতি এ যাত্রায় জিডিপির ৫ শতাংশের আশপাশেই আছে (৫.১৫ শতাংশ)। তবে এই ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে মুদ্রানীতির সঙ্গে বাজেটের সমন্বয় খুব জরুরি। চলতি বছরে ঘাটতি অর্থায়নে এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। আর আসছে অর্থবছরে এর চেয়েও আরো প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ঋণ নিতে হবে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। সরকার ঋণ নেওয়ার ফলে ব্যক্তি খাতের জন্য ঋণ সরবরাহে চাপ তো পড়বেই।

তাই ব্যক্তি খাতের জন্য যে ঋণ সরবরাহ থাকবে তার বড় অংশই যেন উৎপাদনমুখী ও কর্মসংস্থানমুখী উদ্যোগে যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এখানেই মুদ্রানীতির সঙ্গে বাজেটের সমন্বয়ের বিষয়টি জরুরি। শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, একক মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ ও বাজারভিত্তিক সুদের হার নির্ধারণ প্রভাবিত করবে জনগণকে (বিশেষ করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হবে)। প্রাথমিক বিচারে মনে হচ্ছে, মুদ্রানীতির এ দিকগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। আশা করব, সারা বছরই যাঁরা বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছেন আর যাঁরা মুদ্রানীতির নিয়ন্তাÑএই দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমন্বয় থাকবে।

সবশেষে বলতে চাই যে নির্বাচনের বছরেও একটি সংযত ও ভবিষ্যৎমুখী বাজেট দেওয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটের প্রাথমিক পর্যালোচনায় মনে হয়েছে, এই ভারসাম্য বজায় রাখতে বহুলাংশে সফল হয়েছেন আমাদের বাজেট প্রণেতারা। তবে পুরোপুরি সফলতা তো আসবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে। আশা রাখব, সব অংশীজনের কার্যকর পারস্পরিক সহযোগিতায় এই বাজেট বাস্তবায়নে আমরা সফল হব।

লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত