মেহনতিদের মেহনতই যে বাংলাদেশের উন্নতির চাবিকাঠি তার প্রমাণ প্রতিনিয়তই পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি খেলাধুলাতেও। সাফ নারী ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের কিশোরীরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তারা গোল দিয়েছে ২৩টি, খেয়েছে মাত্র একটি। গোলরক্ষক হিসেবে যে মেয়েটি দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছে রুপ্না চাকমা নাম, সে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এক এলাকা থেকে। সে থাকে যে ঘরটিতে তাকে বাড়ি বলা যায় না, বাঁশের একটা কাঠামো মাত্র। মেয়েটির বাবা নেই, দুই ভাই জুম চাষ করে সংসার চালানোর চেষ্টা করে। রুপ্না বের হয়ে আসতে পেরেছে অন্য কোনো কারণে নয়, দুর্দমনীয় ইচ্ছাশক্তির জোরেই। গ্রামের বাইরে প্রাইমারি স্কুলে বিনা বেতনে পড়ত সে, থাকত এক শিক্ষকের বাসায়। আর খেলত। খেলতে খেলতেই খেলোয়াড়। জানা গেল যে মেয়েদের এই জাতীয় ফুটবল দলের ২৩ জন সদস্যের মধ্যে ৮ জন এসেছে গারো পাহাড়ের পাদদেশের এক গণ্ড গ্রাম থেকে। তাদেরও মনের জোর ছিল। খেলার অনুশীলন করেছে, তাই পেরেছে। দলের সদস্যদের একজন, মাসরুরা পারভিন; তার বসবাসের উপযুক্ত কোনো বাড়ি নেই। কাঠমান্ডু থেকে ফেরত এসে গরমে নিজেদের ঘরের ভেতর সে ঘুমাতে পারেনি, গাছতলায় বসে রাত কাটিয়েছে। নারী দলের আরেক কৃতী খেলোয়াড় আঁখির পিতার সঙ্গে পুলিশের দুই সদস্য ‘অশোভন’ আচরণ করেছে বলে খবর বের হয়েছিল। ওই দুই পুলিশ গেছিল আঁখিদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে।
গরিব ঘরের এই নারী খেলোয়াড়রাই বাংলাদেশের জন্য দুর্লভ উচ্চসম্মান নিয়ে এসেছে। তারপরে কী হলো? মহা-হৈচৈ মহা-হট্টগোল। বিমানবন্দরে সাংবাদিক তো অবশ্যই, কৌতূহলী মানুষের এমনই ভিড় যে, মেয়েরা বের হতেই পারে না। কোনো মতে বের হয়ে এসে দেখে কয়েকজনের লাগেজ কাটা। কী ব্যাপার? না, লাগেজ কেটে ডলার হাতিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এরপর দেখা গেল খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিমানবন্দরে যে আয়োজন তাতে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, তার সচিব ও ফুটবল ফেডারেশনের যে কর্মকর্তা উপস্থিত তাদের গলায় ঝুলেছে ফুলের মালা। যেন তারাই জিতেছেন। এটা প্রথম ছবি। দ্বিতীয় ছবি সংবাদ সম্মেলনের। তাতে দেখা গিয়েছে কর্তা-ব্যক্তিরা সবাই সামনের সারিতে বসে আছেন, পেছনে দণ্ডায়মানদের সারিতেও তারাই; খেলোয়াড় দলের অধিনায়ক সাব্রিনা দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে, কোচকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।
এরপর মহাউদযোগ। ছাদখোলা বাসে রাজধানীর রাস্তায় খেলোয়াড়দের অভিনন্দন ও সম্মাননা। সেখানে আরেক ঘটনা অপেক্ষা করছিল। অভিনন্দিত ও দণ্ডায়মান খেলোয়াড়দের মধ্যে একজনের-পার্বত্য চট্টগ্রামের ঋতুপর্ণা চাকমার মাথায় আঘাত করল বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডের ঝুলন্ত পেরেক। রক্তারক্তি ঘটনা। ঋতুপর্ণাকে নিয়ে যাওয়া হলো কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে; মাথায় সেলাই দিতে হলো তিন তিনটি। ঋতুপর্ণা শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারল না।
এই যে নারী খেলোয়াড়দের প্রান্তবর্তিতা, সম্মান জানানোর অসিলায় তাদের অসম্মানিত করা এবং একজনের মাথায় আঘাতপ্রাপ্তির বন্দোবস্ত এসব শুধু যে ঘটনা তা তো নয়, বাস্তবতার উন্মোচনও বৈকি। প্রথম উন্মোচনটা এই বাস্তবতার যে, এদেশের আয়-অর্জন যা ঘটছে তা মেহনতি মানুষের শ্রমের কারণেই। দ্বিতীয় উন্মোচনটি এই যে, সেই মেহনতিরাই সর্বত্র অসম্মানিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, উন্নতির নিজে তো অবশ্যই, তার প্রচার-প্রচারণাও আঘাত করছে সৃষ্টিশীলতাকে, ঋতুপর্ণারা যে জন্য রক্তাক্ত হচ্ছে বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডের পেরেকের ঘায়ে। আর এটা তো প্রমাণিত হলোই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা প্রতিষ্ঠিত সকল জাতীয় অর্জন কুক্ষিগত করতেও তারাই সর্বাগ্রে।
উন্মোচিত হলো আরও একটি সত্য; সেটা এই যে, মেয়েরাও পারে। মেয়েরা খেলবে, তাও আবার ফুটবল এবং ফুটবল খেলে আন্তর্জাতিক সম্মান নিয়ে আসবে এসব তো অল্পদিন আগেও অকল্পনীয় ছিল। মেয়েরা পারে; কিন্তু মেয়েদের সেই সৃষ্টিশীলতাকে দমন করে রাখা হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই সেটা করেছে। ফুটবল দলের এই মেয়েরা যা করতে পেরেছে তার পেছনে একটা কারণ অবশ্যই এই যে, তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্য, পিতৃতান্ত্রিকতার শাসন যেখানে কিছুটা হলেও শিথিল। রাজধানীর মেয়েরা কিন্তু পারে না। রাজধানীতে দেখেছি মেয়েদের নিজস্ব স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলার ব্যাপারেও ধর্মব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ জানিয়েছে। বলেছে ওই কাজ শরিয়তবিরোধী।
গত এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে অনুপস্থিত ছিল ৩৩,৮৬০ জন পরীক্ষার্থী। ধারণা করা মোটেই অসঙ্গত নয় যে, এদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। এটাও অনুমান করি যে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই ঝরে পড়েছে অধিক সংখ্যাতে। কারও বিয়ে হয়ে যায়, কারও বাবা-মা পড়াশোনার খরচ জোগাতে ব্যর্থ হন। কিন্তু এরই মধ্যে কয়েকটি অসামান্য খবর বের হয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে, মেয়েদের কেউ কেউ সে রকমেই অসম্ভব কাজ করেছে যেমনটা করেছে তাদেরই বয়সী নারী ফুটবল খেলোয়াড়রা। যেমন মানিকগঞ্জের একটি মেয়েসন্তানের জন্ম দেওয়ার তিন-চার দিনের মাথাতে এসএসসি পরীক্ষা দিতে চলে গেছে; বাড়ির কাছে নয়, বেশ দূরের পরীক্ষাকেন্দ্রে। কুমিল্লার আরেকটি মেয়ে সুমাইয়া আখতার বাসায় বাবার মৃতদেহ রেখেই গেছে পরীক্ষা দিতে। পিতা কাজ করেন গাড়িচালকের। সুমাইয়া আখতাররা তিন বোন ও দুই ভাই; সে সবার বড়। বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে শিক্ষিত হয়ে শিক্ষকের চাকরি করবে। মেয়েটি মেধাবী, ভালো সংগঠক। পরীক্ষার আগের রাতে বাবার সঙ্গে কথা বলেছে। মধ্যরাত্রিতে পিতা চলে গেলেন। সকালে উঠে আড়াই কিলোমিটার দূরে পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে সুমাইয়া। পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে বাবার মৃতদেহ ধরে বুক চাপড়ে বলেছে, ‘বাবা, বাবা আমি পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। তুমি চোখ খোলো। ও বাবা তুমি চোখ খোলো।’
এই মেয়েদের দাদি নানি খালা ফুফুরা একাত্তরে অকল্পনীয় দুর্ভোগ সহ্য করেছেন। তাদের সাহস ছিল না স্বপ্ন দেখেন মুক্তির। পরে তারা দেখতে পেয়েছেন, স্বপ্ন নয়, নতুন এক দুঃস্বপ্নই ঘিরে ফেলেছে তাদের জীবনকে। তবে দেশের সমষ্টিগত একটা স্বপ্ন যে ছিল সেটা আমরা জানি। বামপন্থি রাজনৈতিক নেতারা তখনো বলেন, স্বপ্নটি ছিনতাই হয়ে গেছে। ছিনতাই নয়, স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে চলে গেছে সুবিধাভোগীদের কাছে। সুবিধাভোগীদের সুবিধা বহু পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষভাবে দুঃসহ হয়েছে মেয়েদের জীবন, একাত্তরে তাদের জীবন বিপন্ন ছিল ভয়াবহভাবে, পরবর্তী সময় সে জীবনের উন্নতি ঘটেনি। ধর্ষণ তো আছেই। গত এক বছরে শুনলাম বাল্যবিবাহ বেড়েছে ১০ শতাংশ।
তা সুবিধাভোগী ঘরের মেয়েরা কী করে? কী করছে? একটা নমুনা পাওয়া গিয়েছিল ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রীনেত্রীদের কাজকর্মে। ইডেন কলেজ অনেক কারণে সুখ্যাত মেয়েদের শিক্ষিতকরণের কাজে তার ভূমিকা ঐতিহাসিক। দেশের রাজনীতিতেও এই কলেজের ছাত্রীদের ভূমিকা রয়েছে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ওই কলেজ খবরে এসেছে শিক্ষাগত বা রাজনৈতিক উৎকর্ষের কারণে নয়, সুবিধাভোগী মেয়েদের বিশেষ রকমের তৎপরতার দরুন। বলাই বাহুল্য যে, এই মেয়েরা সরকার-সমর্থক ছাত্র সংগঠনের অর্থাৎ ছাত্রলীগের সদস্য। তাদের কলহ বেঁধেছে তবে সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনের মেয়েদের সঙ্গে নয়, বিরোধীদের তো কলেজে থাকবারই কথা নয়, এবং তারা নেইও; কলহ নিজেদের মধ্যেই এবং আদর্শগত প্রশ্নে নয়, ভাগ-বাঁটোয়ারার প্রশ্নে। ছাত্রনেত্রীদের নাকি প্রচুর আয়। কলেজ হোস্টেলের ৯০টি কক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারা আসন বিতরণ করে, সালামি নেয়, মাসে মাসে ভাড়াও তোলে। কলেজে যেসব ঠিকাদারি কাজ চলে তার থেকেও বখরা পায়। কিন্তু এসব আয়-রোজগার সংগঠনের প্রধান যে দুজন তাদের কাছেই চলে যায়; অন্য কর্মকর্ত্রীরা বঞ্চিত হয়। আর সেই বঞ্চনার বেদনা থেকেই কলহ, পরস্পরের ওপর হামলা, রক্তারক্তি হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, এবং দুপক্ষেরই থানায় গিয়ে মামলা করা, পরস্পরের বিরুদ্ধে। সাধারণ ছাত্রীদের ক্ষোভ ছিল, তাদের ওপর আর্থিক নির্যাতন তো বটেই, মানসিক, এমনকি শারীরিক বলপ্রয়োগও চলত। দুর্বৃত্ত পুরুষরা যা করতে ভালোবাসে নেত্রীরা নাকি তেমন কাজও করত। মেয়েদের বিবস্ত্র করে ছবি তুলে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাত, এবং ভয় দেখিয়ে বশে রাখত। নির্যাতিত ছাত্রীরা আশা করেছিল এবার অবস্থাটা বুঝি বদলাবে, কিন্তু অবস্থা কী অত সহজে বদলায়, বিশেষ করে ব্যবস্থাটা যদি অক্ষুণ্ন থাকে? ব্যবস্থাটা এমনই যে, এমন খবরও আমাদের পড়তে হয় যে, গরু চুরির দায়ে ছাত্রলীগ নেত্রী গ্রেপ্তার হয়েছে; ঢাকার কাছেই, ধামরাইতে। বোঝা যায় পদে থাকলে কত পদের সুবিধা পাওয়া সম্ভব। সে জন্যই তো মূল দল যে আওয়ামী লীগ, তার সাধারণ সম্পাদক গভীর দুঃখ ও শঙ্কার সঙ্গে দলের লোকদের বলেছেন যে, আওয়ামী লীগের নানা স্তরে ‘এই মুহূর্তে পদবাণিজ্য সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসাতে পরিণত হয়েছে’ এবং উদ্বেগাকুল কণ্ঠে আবেদন করেছেন, ‘টাকায় লেনদেন বন্ধ করুন, দলটাকে বাঁচান।’
লেখক : শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাবু/এ.এস