মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫ ৯ বৈশাখ ১৪৩২
মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫
কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রসর
জিয়াউর রহমান
প্রকাশ: শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৩, ২:৩৯ PM

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলতে বুঝায় এমন এক রাষ্ট্রকে বুঝায় যা জনগণের সামগ্রিক কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে থাকে। জাতিসংঘের ঘোষণা মতে, “কোন রাষ্ট্রকে তখনই কল্যণমূলক রাষ্ট্র বলা যেতে পারে যখন রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা, বৈধব্য অথবা অন্য কোনো কারণে জীবিকার্জনের অক্ষমতায় সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে।” প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ Pigou কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দিকের উপর প্রাধান্য দিয়ে বলেন, The welfare state as one that endeavors to promote the economic satisfaction of its citizens. কল্যাণমূলক রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিশেষ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে তাদের নূন্যতম চাহিদাগুলো পূরণ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। অর্থাৎ, জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বলতে এমন একপ্রকার আধুনিক রাষ্ট্রকে বোঝায় যেখানে সরকার রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসমূহকে শক্তিশালী করতে কিছু মঙ্গলজনক ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। প্রতিটি জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র নাগরিকদের ন্যায়বিচার, সাম্য, সমমর্যাদা, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি সুনিশ্চিত করে। 
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য : কল্যাণমূলক কাজ : কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজ জনসাধারণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কল্যাণমূলক কাজ করা। যে রাষ্ট্র এ ধরনের কাজ বেশি করবে, সে রাষ্ট্র তত বেশি কল্যাণমূলক। যেমন শিক্ষা ব্যবস্থাকে গণমুখী করা, শিক্ষা ব্যয় হ্রাস করা, দরিদ্র জনগণের নিকট শিক্ষাকে সহজলভ্য করা, শিক্ষাব্যবস্থাকে জীবনের উপযোগী করা। প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা : ব্যক্তির কল্যাণার্থে রাষ্ট্র জনগণের, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের একমাত্র মানদণ্ড হলো জনগণের কল্যাণ।

কোনো একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের সর্বাঙ্গিন বিকাশের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সমষ্টিকে সামাজিক কল্যাণ বলে বোঝানো হয়। আবার বলা যেতে পারে যে,  সামাজিক জনকল্যাণ এমন এক ধারণা যার মাধ্যমে রাষ্ট্র সমাজের সকল অংশগ্রহণকারী জনগণের জন্য গুণগতমানসম্পন্ন যত্ন প্রদান করে থাকে। আধুনিক বিশ্বের প্রাথমিক কল্যাণরাষ্ট্র এর উদাহরণ হিসেবে ধরা হয় জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, উরুগুয়ে ও নিউজিল্যান্ড। প্রকৃতপক্ষে, কল্যাণরাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণার গোড়াপত্তন হয় জার্মানিতে। জার্মান সাম্রাজ্যের প্রথম চ্যান্সেলর অটোভন বিসমার্ক ১৮৬০ এর দশকে বৃদ্ধাশ্রম পেনশন, দুর্ঘটনা বীমা ও চিকিৎসা সেবা চালু করেছিলেন যা আধুনিক ইউরোপীয় কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করেছিল। যুক্তরাজ্যের লিবারেল প্রধানমন্ত্রী হারবাট আসকিথ ১৯০৬-১৪ সালে ‘লিবারেল ওয়েলফেয়ার রিফর্ম কর্মসূচির’ মাধ্যমে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাজ্যেকে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। যুক্তরাজ্যে ১৯০৮ সালে ‘ওল্ডএজ পেনশন আইন পাস’ , ১৯০৯ সালে বিনামূল্যে স্কুলে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা, ১৯০৯ এর শ্রম বিনিময় আইন ও শ্রম উন্নয়ন আইন, জাতীয় বেকারত্ব এবং স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য জাতীয় বীমা আইনÑ ১৯১১ জারি করেন। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬০-এর দশকের গ্রেট সোসাইটি আইন হওয়ার ফলে বয়স্ক বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে শুরু করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ কল্যাণ ভাতা প্রদান, মেডিকেলের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা, খাবারের টিকিট, অন্তঃসত্ত্বা, অল্পবয়স্ক মায়েদের জন্য বিশেষ অর্থ প্রদান এবং আবাসন সুবিধা ফেডারেল সরকারের সহায়তাগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৩০ এর দশকে যুক্তরাজ্য ও নর্ডিকের সব দেশ কল্যাণরাষ্ট্রের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়। নর্ডিক কল্যাণরাষ্ট্রগুলোয় যে ব্যবস্থা চালু হয়েছে তা নর্ডিক মডেল হিসেবে পরিচিত।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর মতে ‘সামাজিক সুরক্ষা হলো এমন একটি ব্যবস্থা বা সুরক্ষা যা রাষ্ট্র ব্যক্তি এবং পরিবারকে সরবরাহ করে প্রয়োজনীয়  স্বাস্থ্যসেবা এবং তার প্রবেশ নিশ্চিত করে, আয়ের সুরক্ষার গ্যারান্টি দেয়,  বিশেষত বার্ধক্য, বেকারত্ব, অসুস্থতার ক্ষেত্রে, অবৈধতা, কাজের আঘাত, প্রসূতি বা কমক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা ক্ষতি, পরিবারের উপাজনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু’। আইএলওএর হিসাব অনুযায়ী , বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ লোক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় আছে। ইউরোপিয়ান দেশসমূহে  সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় হয় জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ।

স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়’। জাতির পিতার চিন্তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পায় ১৯৭২ এর সংবিধানে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বিধবা, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার সংযুক্ত করে সামাজিক নিরাপত্তাকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদের উপর ভিত্তি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করেন কেননা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামগ্রিক চিন্তা-চেতনায় সদাজাগ্রত ছিল সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ, অবহেলিত, প্রান্তিক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা, জীবনমান উন্নয়ন। তাইতো স্বাধীনতার পরপর সরকারি কর্মচারীদের পেনশন ও রিলিফভিত্তিক খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্রের যাত্রার শুভসূচনা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ দেশের তৃণমূলের বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ১৯৭৪ সালে ‘পল্লী সমাজসেবা’ নামে কার্যক্রমের শুরু হয়। ‘পল্লী সমাজসেবা’ কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণের সূত্রপাত হয় যাকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কার্যক্রমের সূতিকাগার বলা যায়। এ কার্যক্রম দেশের প্রান্তিক জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে সূচনা করে যুগান্তকারী ইতিহাস। অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ) কার্যক্রম দেশের সর্বপ্রথম সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম যা ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় চালু করা হয়েছিল যার মুল লক্ষ্য ছিল অতিদরিদ্র পরিবারের খাদ্য সহায়তার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ভিজিএফ এর মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হতো। এছাড়া, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে প্রবর্তন করেন কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি যার মূল লক্ষ্য ছিল তৃনমূল পর্যায়ের সাময়িক কর্মসংস্থান সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

পরবর্তীতে সত্তর ও আশির দশকে উদীয়মান এনজিও আন্দোলন ও বৈদেশিক দাতা সংস্থাসমূহের তৎপরতায় বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক উন্নয়নের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  নেতৃত্বে আওয়ামীলিগ যখন ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন সরকার তখন নাগরিকের কল্যাণে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার মতো কর্মসূচিগুলো চালুর পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মেয়েদের জন্য বৃত্তি এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেন। সরকার সামাজিক কর্মসূচির আওতা ও সুবিধাভগীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং সমাজের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীকে টার্গেট করে নতুন নতুন সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। মূলতঃ জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাঁর উদ্যোগে ব্যাপক ভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের উদ্যোগ নেওয়া হয় যা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৯৭-১৯৯৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বয়স্ক ভাতা, ১৯৯৮-১৯৯৯ অর্থবছরে বিধবা স্বামী পরিত্যক্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী চালু করা হয়। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, হিজরা, বেদে, শ্রমিক, চা শ্রমিক, কিডনী, লিভার ও জন্মগত হ্নদরোগীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ৪৯১টি উপজেলায় রোগী কল্যাণ সমিতি গঠন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন, প্রতিবন্ধী কোটা, পথ শিশুদের নিরাপত্তা এবং অতি দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলেন। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সঙ্গে সঙ্গে আরও ২৪টির বেশি মন্ত্রণালয়/ বিভাগ সামাজিক নিরাপত্তায় প্রায় ১২৩টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ১ লক্ষ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা বাজেটের ১৬.৫৮ শতাংশ এবং জিডিপি ২.৫২ শতাংশ।

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী টেকসই করার লক্ষ্যে সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল- ২০১৫ , ভবঘুরে আইন-২০১১, শিশু আইন-২০১৩, মাতা পিতার ভরণ-পোষণ আইন-২০১৩, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরক্ষা আইন-২০১৩ প্রণয়ন করে ব্যাপকভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্রের পথে এক নতুন দিগন্তের উম্মোচন করেন। জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮ এ দেশে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন তা বাস্তবায়নে অনেক এগিয়ে গেছেন বর্তমান সরকার।

মূলত সরকারের লক্ষ্যে হচ্ছে কেউ পিছিয়ে থাকবে না (leaving no one behind) যেমনটি রয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভিষ্টের (Sustainable Development Goal-SDG) মূল কথায়। একারণে, সরকার রুপকল্প-২০৪১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ এবং ডেল্টা প্লান-২১০০ প্রণয়ন করেন। সকল পরিকল্পনায় দরিদ্র মানুষের হিস্যাকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র যন্ত্রকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিবর্তনের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বর্তমান সরকার। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ  স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। অদম্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে দেশ। এই উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে দরিদ্রতা। জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের সময় বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। একটানা ৩ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে গত সাড়ে ১৪ বছরে তিনি এ হার ১৮.৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হতে হলে দারিদ্র্যের হার আরও কমাতে হবে। দেশের অসহায়-দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করতে হবে। ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীন-গৃহহীন ছিন্নমূল মানুষকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের আওতায় আনছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেনÑ ‘বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না।’ ১৯৯৭ সালে আশ্রায়ন  প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র আশ্রায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যারাক, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন প্রকার ঘর ও মুজিববর্ষের একক গৃহে মোট ৫ লক্ষ ৭ হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে যা বিশ্বের বুকে এক বিরল দৃষ্টান্ত। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দরিদ্রতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘খাদ্য ও অন্যান্য সামাজিক সুবিধাদির ওপর জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ বা অধিকার প্রতিষ্ঠাতে অসামর্থ্য হওয়ার কারণেই অর্থাৎ ফেইলিওর অব এন্টাইটেলমেন্ট বা স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার কারণে সমাজে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যদশা দেখা দেয়।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হতদরিদ্র ভিক্ষুক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত, ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল মানুষকে ভূমি ব্যবহারের আওতায় এনে অন্যান্য সামাজিক সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জলবায়ু উদ্বাস্তু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে, দলিত, হরিজনসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সম্প্রদায়কেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ কর্মসূচিতে। বিশ্বে এটি প্রথম ও সর্ববৃহৎ উদ্যোগ, যাতে রাষ্ট্রের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে তুলে আনার জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বাসস্থান নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প বাংলাদেশের দরিদ্রতা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচনের এই নতুন পদ্ধতি ইতোমধ্যে ‘শেখ হাসিনা মডেল’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। ‘শেখ হাসিনা মডেলের মূল ছয়টি বৈশিষ্ট্য যথাÑ ১. উপার্জন ক্ষমতা ও সঞ্চয় বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা; ২. সম্মানজনক জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; ৩. নারীদের ঘরের অর্ধেক মালিকানা দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন; ৪. প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন; ৫. ব্যাপক হারে বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের উন্নতি সাধন এবং ৬. গ্রামেই শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

সরকারের এ ধরণের নানাবিধ পদক্ষেপ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে অর্থনিতিবিদরা মনে করেন। দেশের সর্বস্তরের জনগণকে টেকসই পেনশন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে সরকার ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২৩’ প্রণয়ন করেন এবং পরবর্তিতে এই আইনের আওতায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা ২০২৩ প্রণয়ন করেন। সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা-২০২৩ এ চার ধরণের পেনশন স্কিমের সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রগতি স্কিমÑ বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য; প্রবাস স্কিম প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য; সমতা স্কিমÑ দারিদ্র্যসীমা নিচের জনগোষ্ঠীর জন্য এবং সুরক্ষা স্কিমÑ স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য। মাননীয়  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিম বা কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন যার ফলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাভুক্ত করার জন্য চার ধরনের পেনশন স্কিম চালু হলো। এখন ১৮ বছরের বেশি বয়সি যে কেউ চাঁদা দিয়ে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারবেন এবং সরকার দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু করছে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা। সরকারের ২০ বছর মেয়াদি ২০২১-২০৪১ ২য়  প্রেক্ষিত পরিকল্পনা  অনুযায়ী ২০৩০ সালে বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে এবং ২০৪১ সালে উন্নত স্মার্ট রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাটি বাস্তবায়নে এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে অনগ্রসর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যেই সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনা যায়  এবং ২০৪১ সালে যেদিন আমরা উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশে পরিণত হবে সেদিন যেন বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠী বা একটি লোকও যেন সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বাইরে না থাকে, পায় আজীবন আর্থিক নিরাপত্তা।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা টেকসই হোক এবং বাংলাদেশ ধীরে ধীরে কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হোক, এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা। পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিককে ন্যায্য ও কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারভিত্তিক অন্তর্ভুক্তমূলক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলার মাধ্যমে আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে সুখী ও সমৃদ্ধশালী স্মার্ট বাংলাদেশ।

লেখক : উপসচিব ও কনসালট্যান্ট, এটুআই প্রোগ্রাম 

বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত