দেশসহ বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছেন; দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক ভঙ্গুর এক সামরিক-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছিল। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাকে মাতৃভাষা মর্যাদাদানের দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে এর খণ্ডিত কাঠামোর স্বরূপ উন্মোচিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইন সভার সদস্য কুমিল্লার বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির জোরালো কণ্ঠ ধর্মের মোড়কে পাকিস্তান সৃষ্টির অযৌক্তিকতাকেই সুস্পষ্ট করেছে। পাকিস্তানের তৎকালীন মোট জনসংখ্যার শতকার ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবাদ-আন্দোলন-সংগ্রাম শুধু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে মহিমান্বিত করেনি, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল পটভূমিও রচনা করেছে। যদিও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সূচনাপাঠ হয়েছিল ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক প্রবর্তিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমে। সে সময় রবীঠাকুর রচিত আজকের আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ শুধু বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অকুণ্ঠ সমর্থনকে শাণিত করেনি, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য হোক পুণ্য হোক পুণ্য হোক হে ভগবান’ ইত্যাদি রচনা বাঙালি জাতীয়তাবোধের সঞ্চারণকে অভিনব চেতনায় উদ্ভাসিত করেছে।
ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য সত্য হচ্ছে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই উজ্জীবিত অপরিসীম আত্মত্যাগের মহিমা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মিছিল-মিটিং, পিকেটিং, বিক্ষোভ ইত্যাদির সমন্বিত প্রয়াস জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনের নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ ২১ দফা ঘোষিত হয়। ২৩ জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের সভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যদের আইন সভা থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার করণীয় সম্পর্কে যুক্তি উত্থাপন করেন। ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। মূলত ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে দাবানল প্রজ্বলিত হয় তারই আলোকে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে পরবর্তী সব আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়।
১৯৫৬ সালের ১৪ জুলাই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রদেশ প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বকে পরিহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগের সভায় প্রস্তাব পেশ করেন। ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হলে চকবাজার এলাকায় পুলিশ ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর রাজনীতি নিষিদ্ধ করে সামরিক শাসন জারির পর থেকে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ সময় জেলবন্দি জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর জেল থেকে মুক্তিলাভ করে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার লক্ষ্যে বিশিষ্ট ছাত্রনেতাদের সম্পৃক্ত করে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। আবারো ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন সময় কঠিন জেল-জীবনযাপনের পর মুক্ত হয়ে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন।
বস্তুতপক্ষে প্রস্তাবিত এই ৬ দফাই ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। একই বছর ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটপরিক্রমায় এক নতুন যাত্রার শুভসূচনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের জন্য ভয়ংকর বিপদ-আতঙ্কে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৯৬৯-এর ৫ জানুয়ারি গঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিকে প্রচণ্ডভাবে বেগবান করে। এই আন্দোলনের ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মামলা প্রত্যাহারসহ শাসকগোষ্ঠী মুক্তিদানে বাধ্য হয়। প্রায় দশ লাখ ছাত্র-জনতার সমাবেশ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা ও ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিকতায় পরিপূর্ণ দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও প্রত্যাশিত বাঙালি জাতিসত্তার মূল্য ও ঐতিহ্যবোধসমৃদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের রোডম্যাপ রচিত করে ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের অতুলনীয় প্রাণ বিসর্জন ও ত্যাগের ইতিহাস রচনায় বাঙালি জাতি অর্জন করেছে স্বাধীন সার্বভৌম মাতৃভূমি। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তাঁর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার মূলমন্ত্র ছিল শোষণমুক্ত জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতাকে পরিপূর্ণভাবে অর্থবহ করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অপরিমেয় সাফল্যগাঁথায় অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে বাংলাদেশ যখন নতুন অভিযাত্রায় পদার্পণ করেছিল, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতার হিংসার কৌশলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয় সভ্যসমাজের ইতিহাসে সর্বনিকৃষ্ট, নৃশংস ও বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গমাতা, শিশু শেখ রাসেলসহ প্রায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেড় মাস অতিক্রমকালে খন্দকার মোশতাক ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএইচ রহমান স্বাক্ষরিত ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ শিরোনামে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৫০নং অধ্যাদেশ হিসেবে পরিচিত আইনটি ১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক অনুমোদন দেওয়া হয় এবং পঞ্চম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই জঘন্য আইন প্রবর্তন করার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পরাজিত অন্ধকারের অশুভ অপশক্তি অতি সূক্ষ্ম চতুরতায় দেশকে পুনরায় পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার সব অপকৌশল অবলম্বনে দেশব্যাপী অরাজক-নিষ্ঠুর সামগ্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়। বিরাজিত সব অসঙ্গতি-বিভ্রান্তি-অন্ধকারের শক্তির সব কদর্য পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা পুনরুদ্ধার সংকল্পের কঠিন ব্রতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছরের চরম কষ্টের নির্বাসিত জীবনযাপন শেষে দেশ ও দলের কঠিন দুঃসময়ে সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে অকুতোভয় সংগ্রামী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার আদায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বৈর-সামরিক সরকারবিরোধী গণ-আন্দোল গড়ে তোলেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯০ সালের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে স্বৈরচারী সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ২৩ জুন সরকার গঠনের পর জাতির জনকের হত্যার বিচার দাবি এবং ঐতিহাসিক এই বিচারিক রায়ের কার্যকর বাস্তবায়নের মতো অবিনস্বর কার্যক্রমের জন্য তিনি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। মহান জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলকরণ ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অমীমাংসিত আন্তর্জাতিক গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন, পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি ও ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতিসহ দেশ ও জনকল্যাণমূলক অনেক কর্মযজ্ঞের সফল ও সার্থক বাস্তবায়ন।
২০০৯ সালে পুনরায় নির্বাচিত দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দক্ষ সরকার দুর্নীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং সবক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছিলেন বলেই ২০১৭ সাল নভেম্বর মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের ১৭৩টি দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যে সততার জন্য বিশ্ব শীর্ষ পাঁচটি আসনের মধ্যে নিজেকে তৃতীয় স্থানে অধিষ্টিত করেছেন। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদক ও অপকর্ম-অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত নিজ দল, দলের অঙ্গ-সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগসহ আপন আত্মীয়-স্বজন হলেও কাউকেও ছাড় না দেয়ার ঘোষণায় দেশের সব সচেতন-সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও আকাশচুম্বী প্রশংসায় নেত্রী নন্দিত হয়েছেন। সম্ভাষিত নতুন পালকে অবিসংবাদিত মুকুটে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বনন্দিত ও বরেণ্য সফল রাষ্ট্রনায়কের উপমা তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্বে ধরিত্রী-সমুদ্র-সীমান্ত-মঙ্গা-মহাকাশ-পরিবেশ বিজয়ে সফল ও সার্থক রূপায়ণ তাঁর নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে দেশ পরিচালনায় দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন উঁচুমাত্রিকতায় সমাসীন করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষাসহ বিভিন্ন নীতির আলোকবর্তিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নানামুখী বৈশ্বিক সমস্যা-সংকট উত্তরণে তাঁর অনুপম ভূমিকা এবং সামগ্রিক বিষয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। বহু-দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক উপ-আঞ্চলিকসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অধিকতর অত্যুজ্জ্বল। নারী নেতৃত্ব-নারী উন্নয়ন-নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল ও সংস্থার শীর্ষ বিশ্বনেতৃত্বের স্বীকৃতি শুধু নেত্রীকে নয়; প্রবোধিত আত্মপ্রত্যয় ও আত্মমর্যাদায় বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের অবস্থানকে বিশ্বপরিমণ্ডলে করেছে সুমহান মর্যাদায় সমাসীন। স্বীয় ও রাষ্ট্রের উঁচুমার্গের খ্যাতিকে সুদৃঢ় করার এবং জনগণের প্রত্যাশিত আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রাখার স্বার্থেই দুরূহ কিছু সিদ্ধান্তের দৃশ্যমান বাস্তবায়ন বস্তুতপক্ষে তাঁর ধীশক্তির বিকাশ ও বিস্তার প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনার পরিচায়ক। বলিষ্ঠচিত্তে নির্ভীক স্বাধীনসত্তায় আত্মপ্রত্যয়ী এ মহীয়সী নেত্রী তথাকথিত উন্নত বিশ্বের শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ও অপপ্রচারণা এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব অশুভ চক্রান্ত-প্ররোচনাকে উপেক্ষা করে ইতিমধ্যে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে প্রতিস্থাপন করেছেন। বিশ্বব্যাংকের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে মিথ্যা নাটকের অবসান ঘটিয়ে ‘আমরাও পারি’ ব্রত গ্রহণ করে পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান অবয়বে অবিস্মরণীয় এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৫০ বছরের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মযজ্ঞকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরিক্রমা তথা আশু-স্বল্প-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কার্যকরণ রোডম্যাপে অগ্রসরমান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, লিঙ্গ সমতা, দরিদ্রতার হার হ্রাস, মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ু বৃদ্ধি, শ্রমঘন রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, বিশেষায়িত ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব উন্নয়ন, পোশাক ও ঔষধশিল্পকে রপ্তানিমুখীকরণ ইত্যাদি আজ দেশের আর্থ-সামাজিক দৃশ্যপটে যুগান্তকারী অভিধায় সমুজ্জ্বল। অন্যদিকে ভৌত অবকাঠামো, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, নিজস্ব অর্থায়ানে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাবদ্ধতা নিরসন, সুপেয়-ব্যবহারযোগ্য পানি ও স্যুয়ারেজ প্রকল্পের মতো বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের অব্যাহত বাস্তবায়নসহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের সফলতা-সক্ষমতা অর্জনে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে উন্নয়ন-অগ্রগতির রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত।
জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ গরিব মেহনতি জনতার সুগভীর দরিদ্রতাকে উৎপাটন করে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সুখীসমৃদ্ধ রাষ্ট্র বিনির্মাণের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন; তারই আলোকে তাঁর সুযোগ্য কন্যা ইতিমধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে দেশের ভূমি-গৃহহীন পরিবারের হাতে জমি ও সেমিপাকা বাড়ির দলিল প্রদান সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শুধু বিরল নয়; দৃশ্যমান মানবকল্যাণে বিশ্বশীর্ষ পটভূমি নির্মাণ করেছেন। অতিসম্প্রতি দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনপ্রবাহ বিবেচনা করে বহুল আলোচিত-প্রতীক্ষিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে সামাজিক সুরক্ষায় এক মাঙ্গলিক অধ্যায় রচিত হয়েছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনায় দেশের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ২০৪১ সালে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করার জন্য প্রতিনিয়ত রোডম্যাপ বা রূপকল্প প্রণয়ন/কার্যকর করার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়ার দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। গৌরবদীপ্ত বাংলাদেশ বিশ্বপরিমণ্ডলে শুধু গৌরবোজ্জ্বল ভূখণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি; উন্নয়ন অগ্রগতির বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নির্মাণ করেছে এক অনুপম অধ্যায়। উন্নয়নের রোলমডেলখ্যাত দেশের প্রধান কাণ্ডারি জননেত্রী শেখ হাসিনা অবিচল নিষ্ঠা-দৃঢ়চেতা-প্রজ্ঞার অসাধারণ স্মারকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সফল ও সার্থক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তাঁর নেতৃত্বে গৌরবের উঁচুমাত্রিকতায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের লালসবুজের পতাকা চিরকাল সমুজ্জ্বল মর্যাদায় উড্ডীন থাকবেই- নিঃসন্দেহে তা দাবি করা মোটেও অমূলক নয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাবু/এ.এস