মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫ ৯ বৈশাখ ১৪৩২
মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫
মা ইলিশ রক্ষার অভিযান সফল হবে তো
সুধীর বরণ মাঝি
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩, ৪:৪১ PM
রূপালি ঝিলিক। জাদুকরী স্বাদ। নাম তার ইলিশ। সোনালি আভায় ছড়ানো ইলশ। ইলিশকে বলা হয় আমাদের দেশের সিলভার গোল্ড। রাজনৈতিক  এবং কূটনৈতিক  উপঢৌকনে এ মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইলিশ আমাদের ভৌগলিক নির্দেশক। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ এবং জাতীয় সম্পদ। এর মাধ্যমে অর্জিত হয় বৈদেশিক মুদ্রা। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা বলতে পারি ইলিশের অর্থনৈতিক গুরুত্বও অনেক এবং ইলিশ একটি অতি উপাদেয় ও পুষ্টিকর খাদ্য। ইলিশ পছন্দ কওে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দায়। মাছ যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিগুণে ভরপুর।

তাই ইলিশ রক্ষার দায়িত্ব আমার আপনার এবং সবার। আমাদের সফলতার আরেকটি প্রতীকের নাম ইলিশ। ইলিশ এখন দেশের গণ্ডির বাইরে গিয়েও পররাষ্ট্রনীতিতেও ভূমিকা রাখছে। একটি মা ইলিশ প্রায় ২৩ লক্ষ ডিম ছাড়ে। প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশকে রক্ষা করতে না পারলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে আমাদের অর্থনীতির ওপর, আমাদের জীবনযাপনে।

মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিস, ২০২০ এর তথ্য অনুযায়ী  বিশে^র মোট ইলিশের ৮৬ ভাগ ইলিশ বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। পলিবিধৌত মহিসোপানকে বলা হয় ইলিশের শ্রেষ্ঠ চারণভূমি। ভৌগলিক অর্থনীতিতে শুধু নয় জাতীয় অর্থনীতিতেও একটি সম্ভাবনাময় ইলিশ সম্পদ। পৃথিবীর বিখ্যাত বাংলাদেশের ইলিশের চাহিদাও বিশ্বব্যাপী। বিশেষ করে চাঁদপুরের ইলিশের স্বাদ ও খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তাই বলা হয় ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। তাই আমাদের ভৌগলিক টিকিয়ে রাখতে হলে মা ইলিশ রক্ষার কোনো বিকল্প নাই। চলছে মা ইলিশ রক্ষার অভিযান।

ইলিশ প্রজনন মৌসুম ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের মা ইলিশ রক্ষার অভিযান শুরু হয়েছে। আমরা মা ইলিশ রক্ষার এই অভিযানের সফলতা কামনা করি। ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ মাছ ধরা, বিক্রি ও মজুত নিষিদ্ধি করেছে সরকার। রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের জনগণের উন্নয়নের স্বার্থে মা ইলিশ রক্ষা করার অভিযানকে সফল করতে হবে যে কোনো মূল্যে। মা ইলিশ রক্ষায় সরকারের ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা থাকলেও কিছু অসাধু ব্যক্তির অতিমাত্রার লোভের কারণে গত কয়েক বছর যাবৎ এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। 

পৃথিবীর সুস্বাদু মাছের মধ্যে ইলিশ অন্যতম একটি। পৃথিবীর মোট উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি ইলিশ আমাদের দেশে উৎপাদন হয়। ইলিশ বাস করে সমুদ্রে এবং নদীতে। কিন্তু ডিম পাড়ে নদীতে এবং ডিম পাড়ার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে সমুদ্র থেকে নদীতে চলে আসে। অর্থাৎ মিঠা পানিতে  এবং মিঠা পানিতেই বাচ্চা ফুটে। নদী এবং নদীর মোহনা হলো ইলিশের প্রাকৃতিক হ্যাচারি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনাকে বলা হয় ইলিশের আতুরঘর।  আমাদের নদীগুলো ইলিশের ডিম ছাড়ার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। আমাদের নদীগুলো মা ইলিশের বাপের বাড়ি। সন্তান প্রসবের জন্য বাপের বাড়ি যেমন একজন মায়ের জন্য নিরাপদ ঠিক তেমনি ডিম ছড়ার জন্য এবং বাচ্চা ফুটানোর জন্য নিরাপদ আমাদের নদীগুলো। তাই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি কারর জন্য নিষেধাঙ্গা চলাকালীন ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন মা ইলিশ এবং ডিমওয়লা  ইলিশ ধরা যাবে না। এক ইলিশে ২৩ লক্ষ ডিম। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই একটা নির্দিষ্ট সময়ে সমুদ্রে এবং নদী মাছধরা নিষিদ্ধ থাকে। ইলিশ মাছ দেশের মোট উৎপাদনের শতকরা ১২ ভাগ দখল করে আছে। জাতীয় রপ্তানি খাতে এই খাতের আয় শতকরা চার ভাগ। কিন্তু নির্বিচারে মা ইলিশ এবং জাটকা আহরণ ও নিধনের ফলে এর উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সে কারণে মৎস্য সংরক্ষণ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, ইলিশের অভয়াশ্রম নির্ধারণ ও তা কার্যকর করণ প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ  আহরণ বন্ধ রাখা ও জাটকা নিধন বন্ধকরণ কর্মসূচিকে জোরদার করতে হবে। আমাদের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ভাগ আসে মাছ থেকে। প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূর করতে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। আমাদের অর্থনৈতিকক উন্নয়নে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্য মোচনে এবং প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূরীকরণে মৎস্যখাতের উন্নয়ন নিতান্ত অপরিহার্য। পরিসংখ্যান মতে, দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১২ ভাগ (যার আনুমানকি অর্থমূল্য আট হাজার ১২৫ কোটি টাকা) আসে ইলিশ মাছ থেকে। জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান শতকরা ১ ভাগ।পৃথিবীর সব দেশেই এ মাছের চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে প্রায় ৩শ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।      
                                                                                                           
বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি  জেলেরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিধন করে চলছে মা। এবারও গত কয়েকদিন আগের স্থানীয় এবং জাতীয় পত্রিকার কিছু প্রতিবেদন দেখতে পাই প্রজনন মৌসুমে জেলেরা মা ইলিশ নিধনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তাদের এই প্রস্তুতি যদি সফল হয় তবে মা ইলিশ ধ্বংস হবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জেলেরা মেতে উঠে ইলিশ নিধনে।  এই জেলেরা কি  রাষ্ট্র কিংবা প্রশাসনের চেয়ে অধিক ক্ষমতাধর নাকি প্রশাসনের দুর্বলাতায় জেলেরা এই হীন কাজে মেতে উঠে।

মা ইলিশ রক্ষার অভিযান চলাকালীন সময়ে জেলেদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হলেও কিছু অসাধু এবং অতিলোভী জেলেরা বিশেষ করে ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুণা, পিরোজপুর, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, লহ্মীপুর, মুন্সিগঞ্জ, মাওয়া, গজারিয়া, চাঁদপুরের মতলব, রাজরাজেশ্বর, হাইমচর, কাটাখালী, চরভৈরবী, ফেরিঘাট, ঈশানবালাসহ আরো কিছু কিছু এলাকায় দিনের আলোতে এবং রাতের আঁধারে অনেকটা প্রশাসনের নাকের ডগায় অবাধে নিধন করা হয় মা ইলিশ এবং ডিমওয়ালা ইলিশ। বর্তমান সময়েও এই দৃশ্য চোখে পড়বে না বলে আমরা বিশ্বাস রাখি।  কঠোরতা, জবাবদিহিতা এবং সচেতনতার বিকল্প নেই।  মা ইলিশকে যদি প্রজনন মৌসুমে রক্ষা করতে না পারি তবে ইলিশ আর নদীতে পাওয়া যাবে না, ইলিশ পাওয়া যাবে যাদুঘরে। 

মা ইলিশ রক্ষার পাশাপাশি ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে  নদীতে জেগে ওঠা ডুবো চর ও ভাসমান চরগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে খনন করতে হবে। আর এতে শুধু ইলিশ উৎপাদনই বৃদ্ধি পাবে না রোধ হবে নদীভাঙনও। ইলিশ অনেক দ্রুতগতি সম্পন্ন মাছ। এরা সমুদ্র এবং নদীতে দল বেঁধে চলে। এরা যেই গতিতে সামনে যায় এবং চলার পথে বাধা পেলে  তার চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে পিছনের দিকে ছুটে চলে। তাই ডুবো চর এবং ভাসমান চরের কারণে নদীতে ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে পক্ষান্তরে মায়ানমারে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী দূষণ এবং নদী দখল ইলিশসহ মিঠা পানির অন্যান্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিও ক্ষেত্রে বড় বাধা। 

 মা ইলিশ রক্ষার অভিযানকে সফল করতে হলে প্রশাসনের নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। মা ইলশ রক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপের কঠোর হস্তে সফল বাস্তবায়ন করতে হবে। অভিযানে কেউ যেন কোন প্রকার সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে সেদিকে প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদেরকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রশাসনের পাশাপাশি আামাদের সেনাবাহিনীকেও ইলিশ রক্ষার অভিযানকে সফল করার জন্য কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে।  মা ইলিশ রক্ষার অভিযানকে সফল করার জন্য আমাদের প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াকে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে।  মা ইলিশ রক্ষার উপকারীতা মিডিয়ার মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে তুলে ধরতে হবে। এই অভিযানকে সফল করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সচেতন নাগরিককেও এগিয়ে আসতে হবে। লোক দেখানো অভিযান নয়, চাই মা ইলিশ রক্ষার সফল অভিযান। আমরা আশা করি মা ইলিশ ও ডিমওয়ালা ইলিশ রক্ষার অভিযান সফল হবে। তা যতই কঠোর ও কঠিনই হউক। অভিযান ব্যর্থ হলে তা আমাদের পরাজয়। আমরা আমাদের পরাজয় চাই না। যেভাবেই বলি ডিম ছাড়ার মৌসুমে মা ইলিশ ও ডিমওয়ালা ইলিশ রক্ষার বিকল্প নেই। 

লেখক : শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত