কুমিল্লা নগরীতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ মিছিলে ধাওয়া করে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে মিছিলে বাঁধা দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়ায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
আজ শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে কুমিল্লা নগরীর নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্তত ৪ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজনের মাথা ফেটে গেছে।
সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসকে নিয়ে মুন্সিগঞ্জের মেয়র ফয়সাল বিপ্লবের ‘সাম্প্রদায়িক গালিগালাজ’, কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ‘দুর্গাপূজাকে কটাক্ষ করে মন্তব্য’, কুড়িগ্রামের চারণ কবি রাধাপদ রায়ের ওপর হামলা এবং বিভিন্ন জায়গায় পূজার প্রাক্কালে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে দেশব্যাপী এই প্রতিবাদে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে কুমিল্লায় এই বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শারদীয় দুর্গাপূজার প্রস্তুতি সভায় কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের দেওয়া একটি বক্তব্যকে নিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক চলছে গত কয়েকদিন ধরে। গত ৪ অক্টোবর কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রস্তুতি উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে ‘মদ মুক্ত’ পূজা উদযাপনের আহ্বান জানান কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহাউদ্দিন বাহার।
পূজা চলাকালে মদ খেয়ে মণ্ডপে নাচানাচি না করে মাদকমুক্ত পূজা আয়োজনের আহ্বান জানিয়ে এমপি বাহার বলেন, পূজা চলাকালে মদ খেয়ে নাচানাচি বন্ধ করতে হবে। আসুন কুমিল্লা থেকেই শুরু হোক মাদকমুক্ত পূজা আয়োজন।
মণ্ডপে লিখে দেবেন ‘মাদকমুক্ত পূজা’। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এ ঘটনার ৯ দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে কুমিল্লা টাউনহল অডিটোরিয়ামে এক সভায় আবারও মদ মুক্ত পূজা করার আহ্বান জানিয়েছেন সংসদ সদস্য বাহার। এ সময় কুমিল্লায় মদ ও মাদকমুক্ত পূজা হবেই বলে ঘোষণা দেন তিনি।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তাপস বকশী বলেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে প্রথমে পুলিশ বাঁধা দেয়।
পরে মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের মিছিলে ধাওয়া করে হামলা চালায়। এতে এক নারীসহ অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন। এমপি বাহার দুর্গাপূজায় মদ খাওয়া নিয়ে কটূক্তি করায় আমরা কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ করতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি।
সংগঠনের নেতাকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শুক্রবার সকাল ১০টায় নগরীর নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকার রাজস্থলী মন্দির এলাকায় বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিষদের জেলা সভাপতি চন্দন রায়। প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অংশগ্রহণকারীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নগরীর কান্দিরপাড় পুবালী চত্বরে আসছিল। এ সময়ে পুলিশ নগরীর নজরুল অ্যাভিনিউ সড়কের কর ভবনের সামনে তাদের বাঁধা দেয়। এ সময় নগরীর কান্দিরপাড় পুবালী চত্বর থেকে মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েক’শ নেতাকর্মী মিছিলকারীদের ধাওয়া করে হামলা করে। এতে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর মিছিলকারীরা রানীর বাজার এবং মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কান্দিরপাড় পুবালী চত্বরে অবস্থান নেন।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহমেদ সঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, আমরা কর্মসূচিতে বাধা দেইনি। মূলত সংঘাত এড়াতে পুলিশ মিছিলটিকে কান্দিরপাড়ের পুবালী চত্বরে যেতে দেয়নি। কারণ কান্দিরপাড়ে মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান করছিলেন। আকস্মিক তারা মিছিল নিয়ে এসে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করেন। পরে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিই। এখন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
এদিকে, হামলায় আহতদের দেখতে তাদের বাসায় গিয়েছেন জেলা প্রশাসন খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান এব জেলা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল মান্নান। এ সময় ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে জানান তারা।
পুলিশ সুপার মো.আব্দুল মান্নান বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে কুমিল্লা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আবদুল আজিজ সিহানুকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা রিসিভ করেননি।
জানা গেছে, গত ৪ অক্টোবর কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের মদমুক্ত পূজা করার আহবান জানানোর ওই ভিডিওটি এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। ঘটনার দুইদিন পর ৬ অক্টোবর এমপি বাহারের এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা। এর প্রতিবাদে তাঁরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি বাহারকে মনোনয়ন দেওয়া হলে এর খেসারত তাঁকে দিতে হবে। এ ছাড়া একই দিন শুক্রবারের এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন তাঁরা। এর প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার কুমিল্লা টাউন হল মিলনায়তনে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের ব্যানারে সভা হয়।
‘শান্তিপূর্ণ কুমিল্লাকে অশান্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কিছু স্বার্থন্বেষী মহল শারদীর দুর্গাপূজা নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের সাথে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তারই প্রতিবাদে মতবিনিময় সভা’ শিরোনামে ওই প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। পরিষদের সভাপতি শিব প্রসাদ রায়ের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন। এ সময় তিনি দাবি করেন, তাঁর বক্তব্যকে বিকৃতভাবে ছাপিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। কেন্দ্রীয় নেতাদের বিবৃতিতে তিনি হতবাক হয়েছেন। পরে এমপি বাহার ঘোষণা দেন কুমিল্লা মহানগরে শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) সকালে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এবং বিকেলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগ শান্তি সমাবেশ করবে।
বাবু/এএস