১৯৩০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট মহামন্দায় জনজীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ-দুর্দশা। এ সময় থেকে মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ি ও নিত্যপণ্যের মূল্যেও ঊর্ধ্বগতির সংস্কৃতি ব্যবসায়ী মহলে শুরু হয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টার মাঝে ১৯৩৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেসরকারীভাবে প্রথম ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। মার্কিন মুলুকে সূচিত ভোক্তা আন্দোলন ইউরোপ হয়ে পর্যায়ক্রমে এশিয়া-আফ্রিকাসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমূহের বাজারজাতকরণ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তা সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণ করাই ছিল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের মূল লক্ষ্য। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন. এফ কেনেডির উদ্যোগে মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থে চারটি অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। এ চারটি অধিকার হল ১. পণ্য ও সেবা কিনে বা গ্রহণ করে নিরাপত্তা পাবার অধিকার; ২. পণ্য বা সেবা বিষয়ে ভোক্তার তথ্য জানার অধিকার; ৩. ন্যায্য মূল্যে পছন্দসই পণ্য বা সেবা ভোগের অধিকার এবং ৪. অভিযোগ করার এবং প্রতিনিধিত্বের অধিকার। মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ঐতিহাসিক দিনটি স্মরণে প্রতিবছর ১৫ মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক ভোক্তা অধিকার দিবস। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে জাতিসংঘ ভোক্তা অধিকার রক্ষার নীতিমালায় কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরো বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরো আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করা হয়। কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৫ মার্চকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে বৈশ্বিকভাবে পালন করা হয়।
একজন বিক্রেতার বা উৎপাদকের অধিকার রয়েছে উৎপাদিত পণ্য থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ লাভ করা। বিপরীতে একজন ভোক্তার অধিকার রয়েছে তার পরিশোধিত মূল্যের বিনিময়ে নির্ধারিত পণ্য পাওয়া। বাজার ব্যবস্থার প্রধান দুটি দিক হলÑ ক্রেতা ও বিক্রেতা। যদিও যিনি ক্রেতা তিনি ভোক্তা নাও হতে পারেন তবে ধরা হয় ভোগের উদ্দেশ্যেই তিনি ক্রয় করেন। অর্থাৎ তিনিই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে ক্রেতার যে অধিকারগুলো আছে বলে জানা দরকার তা আমাদের দেশে খুব কম মানুষই জানে। সেজন্যই একদিকে যেমন অসাধু ব্যবসায়ী লাভবান হয় তেমনি বাজার ব্যবস্থাও প্রভাবিত হয়। একজন ক্রেতার সাথে ভোক্তার সম্পর্ক হবে আন্তরিক এবং বিশ্বস্ততা পূর্ণ। অর্থাৎ নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে ভোক্তা যে পণ্যটি কিনবে তা যেন কিনে যেন সে না প্রতারিত হয়। যদি এভাবে সম্পর্ক এগিয়ে যায় তাহলে উভয়ের ভেতর হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে। ভোক্তা হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি। এগুলো হলÑ মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার।
প্রায়ই দেখা যায় প্রতিশ্রুত সেবা প্রদানে অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঠিক সেবা না দেয়ার কারণে প্রায়ই জীবনহানি ঘটছে। জীবনহানির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিক্রিয়া দেখালে বা সুবিচার চাইলে এসব অসাধু সেবাদাতারা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করছে বা সামগ্রিকভাবে অন্য সেবাগ্রহীতাদের সেবাদানে বয়কট করছে। আমরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে মেডিকেলে, বাস, লঞ্চ-স্টিমারের ক্ষেত্রে এসব সমস্যার সম্মুখীন হই। এটা মূলত আইন মান্য না করা এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের জাতীয় দীনতা, হীনতার বহিঃপ্রকাশ বৈকি। একজন চিকিৎসক কিংবা অন্য কোনো সেবাদাতাকে যে অপরাধের জন্য তার লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল, ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল, তা না করে সে ঔদ্ধতপনা করছে, আস্ফালন করছে, হুমকি দিচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন ধরনের শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় সে দ্বিগুণ হারে অপরাধ করছে। এর সবকিছুই আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এছাড়া যে দেশ নকল-ভেজালের স্বর্গরাজ্য-কৃষিতে-জমিতে ভেজাল, করোনা টেস্ট এর রেজাল্ট ভেজাল, রাজনীতিতে ভেজাল, নেতাতে ভেজাল, খেলার মাঠে ভেজাল, শিল্পী সমিতিতে ভেজাল, বিচারক ভেজাল, শিক্ষায় ভেজাল, চিকিৎসায় ভেজাল (অবহেলায় রোগীর মৃত্যু) আর সেখানে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সন্ধান কতটা যৌক্তিক? কিন্তু এরপরও মানুষের চাহিদা ভেজালমুক্ত পণ্যের সন্ধান থাকবেই চিরকাল। অসচেতন ভোক্তার নিরবতা ও নির্লিপ্ততায় অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে-পণ্যে বিষাক্ত ক্যামিক্যাল দিয়ে খাবারকে বিষে পরিণত করে জনগণের পকেট কেটে টাকার পাহাড় গড়ছে অনায়াসেই। বাংলাদেশে পাঁচ কোটি লোক খাদ্য বিষক্রিয়ায় ভুগছে। রাজধানী ঢাকার পঞ্চাশ থেকে ষাট ভাগ সবজিতেই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশানো থাকে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ৭৬টি খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে যার চার ভাগের তিন ভাগ নমুনায় ভেজাল পায়।সারাদেশে অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ কোম্পানি ২৪৬টি, আয়ুর্বেদিক কোম্পানি ২২৪টি, ইউনানি কোম্পানি ২৯৫টি, হোমিওপ্যাথিক প্রতিষ্ঠান ৭৭টি সহ মোট ৮৪২টি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট তৈরি করছে ১০৬টি প্রতিষ্ঠান। ৪০ থেকে ৫০টি ব্যতীত বাকি কোম্পানিগুলো নকল, ভেজাল ও ন্নিমানের ঔষধ তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখেছেন নকল ও ভেজাল ঔষধের অনেকগুলোর মধ্যে কোনো কেমিকেল উপাদান নেই। ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয় এসব ঔষধ।
আজকাল অসাধু ব্যবসায়ী চাতুর্য্যপূর্ণ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট করে ক্রেতাকে ঠকাচ্ছে। ওজনে কম, নিম্নমানের পণ্য দেওয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য দেওয়া বা মূল্য অনুযায়ী সেবা না দেওয়া ইত্যাদি নানাভাবে প্রতারিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়া যায়। অথচ এটা অনেকেই জানে না বা জানলেও তা করছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম না বাড়লেও দেশীয় বাজারে কালোবাজারি, মজুদদারির মাধ্যমে লবণ, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশ এক নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। রমজান মাস ইবাদতের মাস। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে রমজান মাস উপলক্ষ্যে দ্রব্যমূল্য কমানো হয়। অথচ আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে রমজান মাসকে উপলক্ষ করে সবজি, ফলমূল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি হয়। ভোক্তা হিসেবে পরিতাপের বিষয়। সত্যিই আমরা অবৈধ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে অসহায় জীবন যাপন করছি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাজার পরিলক্ষিত বিষয় হচ্ছে যে, সরকার যেখানে ভোজ্য সয়াবিন তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সেখানে আমাদেরকে অতিরিক্ত দামে ক্রয় করতে অনেকটা দোকানদাররা বাধ্য করছে। নির্ধারিত দামে পণ্য ক্রয় করতে চাইলে দোকানদার বলে যে পণ্য নেই অথচ তারা অতিরিক্ত মুনাফার উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বাজারে পণ্যের সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এমত অবস্থায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের লোকেরা টিসিবির গাড়ির পিছনে ছুটেও কাঙ্খিত পণ্য লাভ করতে পারছে না। কেউ কেউ অদূর ভবিষ্যতে বা সামনে রমজান উপলক্ষ্যে আরও মূল্য বেড়ে যাবে এই ভয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য বাসায় মজুদ করে রাখছি এতে করে যোগান এবং চাহিদার ভারসাম্যহীনতার কারণে অনেকেই অর্থ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পণ্য পেতে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। তাই এসব কাজে আমাদের জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যের দাম যে হারে বাড়িয়েছে বাস মালিকরা তার থেকে অনেক বেশি ভাড়া বাড়িয়েছে। এমনকি যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। করোনাকালীন সময় আমরা লক্ষ্য করেছি সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি আসন ফাঁকা রেখে দূরপাল্লার বাস চলবে এবং যাত্রীকে দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হবে। বাস মালিক-শ্রমিকরা ভাড়া দ্বিগুণ নিয়েছে ঠিকই আবার দুটো আসনে যাত্রীও বসিয়েছে। প্রতিবাদ করতে গেলে জবাবে শোনা যায় দীর্ঘদিন যাবৎ তারা রাস্তায় না থাকার কারণে তাদের অনেক খরচ এবং ঋণ বেড়ে গেছে তাই এখন সেটা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে অথবা আপনি তো একাই এই গাড়িতে বলছেন আর তো কারো সমস্যা হচ্ছে না, আপনার যদি সমস্যা হয় তাহলে নিজে একটি প্রাইভেটকার কিনে সেটাতে চলাফেরা করেন অথবা অন্য গাড়িতে চলে যান ইত্যাদি ইত্যাদি। আর অতি লোভী ডাক্তার বাবুর কাছে গেলেই রোগের নাম শোনার আগেই হাতে লিস্ট ধরিয়ে বলেন যেই পরীক্ষাগুলো করে নিয়ে আসেন তারপর কথা বলবো মাত্রাতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় ল্যাব টেস্ট এর কারণে চিকিৎসা ব্যয় শুধু বেড়েই যাচ্ছে না এ ক্ষেত্রে রোগী মানসিক এবং শারীরিক ভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনেক সময় ভুল রিপোর্টের কারণে ভুল ট্রিটমেন্ট হচ্ছে। কিছু ডাক্তারের হাতে লেখাতো বুঝাই যায়না। নির্ধারিত ফার্মেসী ছাড়া ওই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ওষুধ পাওয়া যায় না ।অথচ এই ডাক্তার কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়ালেখা করেছে। এখন তারা ইচ্ছামত ফি নির্ধারণ করে দিচ্ছে ।রোগী দেখাতে গেলে সর্বনিম্ন দশ হাজার টাকা নিয়ে যেতে হয়। স্বাস্থ্যসেবায় দালাল, নার্স কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য তো আছে ই। অপ্রয়োজনীয়' ও ভুল অপারেশনের কারণে অনেকেই জীবনে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। এসব থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্যই ভোক্তা অধিকার দিবস। আসুন আমরা যারা সেবাদানের সাথে জড়িত আছি আমরা সকলে আরো বেশি মানবিক হয়ে মানুষকে ভালোবাসে সেবাদান করে। কারণ আমি শুধু সেবা দাতাই নই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি সেবাগ্রহীতা। আমি যদি মানুষকে ভাল সেবা না দেই তাহলে অপরের কাছ থেকে আমি ভালো সেবা আশা করতে পারি না। মনে রাখবেন আপনি ভালো মন্দ যা দিচ্ছেন তাই একদিন ফেরত পাবেন অপরের কাছ থেকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ ও তাদের অধিকার রক্ষায় একটি কার্যকর আইন প্রণয়নের দাবি ছিল দীর্ঘ দিনের। তারই প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯। ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে (ক) কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা, (খ) জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা, (গ) মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য, কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোনো পণ্য বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা, (ঘ) কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রির উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা, (ঙ) প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা, (চ) কোনো পণ্য সরবরাহ বা বিক্রির সময় ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজন অপেক্ষা কম ওজনের পণ্য বিক্রি বা সরবরাহ করা, (ছ) কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শনকারী হওয়া, (জ) কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত পরিমাপ অপেক্ষা কম পরিমাপের পণ্য বিক্রি বা সরবরাহ করা, (ঝ) কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দৈর্ঘ্য পরিমাপের কাজে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছু প্রকৃত দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অধিক দৈর্ঘ্য প্রদর্শনকারী হওয়া। (ঞ) কোনো নকল পণ্য বা ওষুধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা, (ট) মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা এবং সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে এমন কোনো কাজ করা, যা কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপরও আইনটি প্রণয়নের ফলে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ভোক্তা তথা জনগণ এর সুফল পেতে শুরু করেছে। আগে যেখানে অসাধু ব্যবসায়িরা প্রকাশ্যেই পণ্যে ভেজাল মেশাতেন, আজ সেখানে কিছুটা হলেও রাগঢাক করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ভোক্তা অধিকার আইন প্রণয়নের ১৩ বছর পরও আইনি দুর্বলতায় ও প্রচারণার অভাবে সুফল মিলছে না। ভোক্তা অধিকার লংঘনের দায়ে কোথায় কিভাবে অভিযোগ করতে হবেÑ এ সম্পর্কে জানা না থাকার কারণে ভোক্তারা অধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে অভিযোগ করতে পারছে না। অনেকে সচেতন না হওয়ার কারণেও অভিযোগ করছে না। ভোক্তা অধিকার লংঘন ঠেকাতে প্রতিষ্ঠিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কার্যক্রম কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। ফলে ভোক্তারাও এর কোনো সুফল পাচ্ছে না। বোতলজাত পানি, চকোলেট, চিপস, বিস্কুট, চানাচুরসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য বিএসটিআইর ‘বাধ্যতামূলক’ তালিকায় রয়েছে। অথচ অনেক কোম্পানি বিএসটিআইর সনদ ছাড়াই এসব পণ্য বাজারে বিক্রি করছে। পণ্যের মোড়কের গায়ে পণ্যের বিবরণ, ওজন, প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ও বিএসটিআইর মানচিহ্ন থাকার কথা। বেশিরভাগ ছোট কোম্পানি এসবের ধার ধারে না। রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে বিএসটিআইর মান-সনদবিহীন আইসক্রিম ও পানীয় দেদার বিক্রি হচ্ছে। যেমন- বিভিন্ন দোকানে মেসার্স লাকী স্টোরের নাম ব্যবহার কওে স্পেশাল লেমন ললি আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে। অথচ এই লাকী স্টোরের কোনো ঠিকানা পণ্যের মোড়কে নেই।
একুশ শতকের উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থার যুগে নিরাপদ, মানসম্পন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য ও সেবা পাওয়া প্রত্যেক ভোক্তার অধিকার। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও ক্রমবিকাশমান বাজার ব্যবস্থাপনার দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ রোধ করা খুবই জরুরি। দেশের ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১০ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দেশের ১৬ কোটি ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জনবল খুবই নগণ্য। জনবল সংকট থাকায় প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিংসহ ভোক্তা স্বার্থরক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা অধিদপ্তরের পক্ষে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। আইনে দেশের প্রচলিত পণ্যের গ্রাহকদের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের গ্রাহকদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। সম্প্রতি বিভিন্ন ইকমার্স প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি, ডিজিটাল আর্থিক খাতে প্রতারণা, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণা, অনলাইনে অবৈধভাবে ঋণদানের নামে প্রতারণা, ইটিকেটিংয়ের ক্ষেত্রে মনগড়া সার্ভিস চার্জ আদায় এরই প্রমাণ। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিভিন্ন উদ্যোগ ও ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি দেশের ডিজিটাল মাধ্যমে একটি বিশাল ভোক্তাগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় ইকমার্স সেবা, অনলাইন রাইড শেয়ারিং, অনলাইন ফুড ডেলিভারি সিস্টেম, ইটিকেটিং, বিভিন্ন সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট ও অ্যাপের ক্রেতা, অনলাইনে বিভিন্ন সেবার গ্রাহক, মোবাইল ব্যাংকিং খাতের গ্রাহক ও টেলিকম সেক্টরের ভোক্তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আইনের মাধ্যমে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।
ভোক্তা অধিকার উন্নত বিশে বহুদূর এগিয়েছে। উন্নত বিশ্বে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে কঠোর অবস্থান রয়েছে। আমি, আপনি ও আমাদের সন্তান সবাই একজন ভোক্তা। প্রত্যেকের নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন হওয়ার অধিকার রয়েছে। কেউ সেবার নামে প্রতারণার আশ্রয় নিলে অভিযোগ করার আইনগত অধিকার আমাদের রয়েছে। আমরা যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে ভোক্তা অধিকার বিষয়টি থেকে যাবে অন্তরালে। একটি দিবস আমাদের সাময়িকভাবে সেই দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরে। আমাদের উচিত সেই দিবসের গুরুত্ব বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা। এর ফলে ভোক্তারা পণ্য ক্রয়ে প্রতারিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। একজন বিক্রেতার বা উৎপাদকের অধিকার রয়েছে উৎপাদিত পণ্য থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ লাভ করা। বিপরীতে একজন ভোক্তার অধিকার রয়েছে তার পরিশোধিত মূল্যের বিনিময়ে নির্ধারিত পণ্য পাওয়া। আমরা যদি প্রাপ্য অধিকারের বিষয়ে সরব না হই অসাধুরা প্রতারণা চালিয়েই যাবেন।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ী সমাজ সংঘবদ্ধ এবং সুসংগঠিত। অপরদিকে ক্রেতা-ভোক্তারা অধিকার সচেতন এবং সংগঠিত নয়। অসংগঠিত ভোক্তা সাধারণ সর্বদাই তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এখন সময় এসেছে ভোক্তাদের সংগঠিত হওয়ার। নিজের অধিকার বিষয়ে সোচ্চার এবং দায়িত্ব পালনে দায়িত্বশীল হওয়ার। ভোক্তা সাধারণ নিজেদের অধিকার আদায়ে সংগঠিত হলে অচিরেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনের বাস্তবায়নকারীরা আরও দায়িত্বশীল হবেন। সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা প্রবর্তনে ক্রেতা-ভোক্তাদের সচেতনতা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ভোক্তাদের অনুকূল আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।তাই ভোক্তাই প্রথম, ভোক্তারাই সর্বে সর্বা । ভোক্তারাই সব শক্তির উৎস। আমরা ভেজাল পণ্য না কিনলে উৎপাদনকারী কোম্পানি যত বড়ই হোক না কেন একদিন তাকে পথে বসতেই হবে। আসুন, আমরা ভোক্তার অধিকার বিষয়ে সচেতন হই, ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি। সেই সাথে ভেজালের বিরুদ্ধে সচেতন ও সোচ্চার হই। ভোক্তার অধিকার রক্ষায় আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর