ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টর সরকার হল বর্তমান সরকার। গত শনিবার সকালে হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ করে, হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এবং প্রকাশ্যে বেসামরিক মানুষকে অপহরণ ও হত্যা করে। এই আক্রমণ এই ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্ব একটি নতুন বিশৃঙ্খলার মধ্যে জড়িয়ে যেতে পারে। হামাসকে সমর্থনকারী বিশ্বের দেশগুলো এটি বুঝে যে, হামাসের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর এই ধরনের পদক্ষেপে পরিণতি খুব ভয়ঙ্কর হবে। তারপরেও তারা বড় ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক। কারণ বিশ্ব একটি মাল্টিপোলার নতুন পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আগের মতো বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্র বা প্রভাবশালী শক্তি নয়। আমেরিকা কখনো ফিলিস্তিনি স্বার্থের জন্য সামান্য উদ্বেগও দেখায়নি। বরং ইসরায়েলের ক্ষেত্রে, সর্বাধিক ইসরায়েলের বিজয় কামনা করেছে। যদিও নেতানিয়াহু বর্তমান এই সংঘাত বা এই নতুন যুদ্ধ শুরু করেনি, সম্ভাব্যভাবে ইরানের সমর্থনে হামাস এই সংঘাত বা এই নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে। কারণ ইরান হামাসের দীর্ঘদিনের সমর্থক। তবে এটি সঠিক যে ইসরাইল এবং হামাসের মতো ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর মধ্যে অশান্তির মূল কারণ হলো দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতন, হত্যা এবং নেতানিয়াহুর চরমপন্থা অবলম্বন।
মধ্যপ্রাচ্যে বিগত ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েল এবং অন্য চারটি দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান এবং মরক্কোকে আব্রাহাম অ্যাকর্ড নামে পরিচিত কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর করতে রাজি করায়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মধ্যে একটি চুক্তির বিষয়ে নিয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুতরাং এটি বলা যেতে পারে যে, ইসরায়েল-সৌদি চুক্তিকে দুর্বল করার জন্য হামাস ইসরায়েল আক্রমণ করেছে। এই ধরনের একটি চুক্তি হামাসের পৃষ্ঠপোষক ইরানকে বিচ্ছিন্ন করতে পারতো এবং হামাসের চেয়ে আরও মধ্যপন্থি গোষ্ঠী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য সৌদি অর্থের যোগান কমাতে পারতো। কিন্তু সাম্প্রতিক হামাসের হামলার কারণে যদি ইসরায়েল গাজা উপত্যকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে, তাহলে সৌদি আরবের যেকোনো চুক্তিতে রাজি হওয়া কঠিন হবে। হামাসের হামলার কারণে সৌদি আরব আব্রাহাম অ্যাকর্ডস চুক্তিকে বাতিল না করলেও এটি পিছিয়ে যাবে। সুতরাং বলা যায় হামাসের আক্রমণ আমেরিকান শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা রোধ করার একটি প্রচেষ্টা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বকে আমেরিকার বাইরের বিশ্বে নতুন মোড়ল রাষ্ট্র বা প্রভাবশালী শক্তির মেরুকরণের প্রচেষ্টা।
ইসরায়েল হামাসের দখলকৃত শহরগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে এবং গাজাকে সম্পূর্ণ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসরায়েলে হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। ইসরায়েলও বিমানবাহিনীর ও রকেট বোমার মাধ্যমে গাজার ভবন, মসজিদ ও মার্কেটপ্লেসগুলোতে আঘাত হানছে এবং শত শত হামলায় গাজার ভবন ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করে ফেলেছে। এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি মারা গেছে। হামাসের এই হঠাৎ হামলায় সবাই অবাক, ফিলিস্তিনিরাও বলেছে যে তারা হামাসের হামলায় হতবাক। বর্তমানে হাজার হাজার ইসরায়েলি সৈন্য এবং ট্যাঙ্ক গাজার দক্ষিণ সীমান্তে রয়েছে। একটি স্থল হামলার সম্ভাব্য প্রস্তুতি। নেতানিয়াহু বলেছেন আমরা একটি দীর্ঘ এবং কঠিন যুদ্ধ শুরু করছি।
হামাস এবং অন্যান্য জঙ্গিরা আনুমানিক ১৫০ জন ইসরায়েলের নাগরিককে জিম্মি করে রেখেছে। তারা মানুষের ঢাল বা দর কষাকষির কারণ হয়ে উঠতে পারে। শনিবার ভোরের পরপরই ইসরায়েলর একটি সঙ্গীত উৎসবে জঙ্গিরা রাভারদের হত্যা করে এবং জিম্মি করে। পেন্টাগন ইসরায়েলে যুদ্ধাস্ত্র পাঠিয়েছে এবং একটি বিমানবাহী রণতরীসহ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলোকে এই অঞ্চলের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে মানুষ। হামলার পূর্বাভাস দিতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা তাদের খ্যাতি এবং নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করতে পারে। হামাসের ইসরায়েল আক্রমণ একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। হামাস ইহুদি রাষ্ট্রের উপর আক্রমণের জন্য যে তারিখটি বেছে নিয়েছিল তা কোনও কাকতালীয় ছিল না, কারণ অক্টোবর হলো ইসরায়েলে ইয়োম কিপুর যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় ৫০ বছরপূর্তি। রাশিয়া বলেছে, ইসরায়েল-হামাস সংঘর্ষ এ অঞ্চলের জন্য বড় বিপদ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পরিস্থিতিটিকে একটি শান্তিপূর্ণ দিকে নিয়ে আসা প্রয়োজন, কারণ এই ধরনের সহিংসতার ধারাবাহিকতা অবশ্যই এই সংঘাতকে আরও বৃদ্ধি করবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মস্কোতে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বর্তমানে বৃদ্ধির সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্তিতি শুরু হয়েছে। হামাসের এই হঠাৎ আক্রমণ ইসরাইলকে যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করতে এবং বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গাজায় প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে প্ররোচিত করেছে। এই জটিল এবং দীর্ঘদিনের সমস্যার কোনো সহজ উত্তর নেই। দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত সরাসরি জড়িতদের জীবন ধ্বংস করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক ভিত্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার এবং কূটনৈতিক অবস্থা দুঃখজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে কারণ সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানবিক সংকট প্রসারিত হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অতীত এবং বিভিন্ন দিকসহ, এই সংঘাতের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে যা গাজা এবং ইসরায়েলের সীমানায় ছাড়িয়ে পড়েছে। গাজায় ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন (হামাস) এবং লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহ উভয়ে দ্বি-ফ্রন্ট সংঘাতের জড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বিধ্বংসী পরিণতি বয়ে আনবে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী চলমান সহিংসতার সময় লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
চলমান সহিংসতার মুখে বিশ্ব মোড়ল রাষ্ট্রগুলো, আরব রাষ্ট্রগুলোর পদক্ষেপ বারবার অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এক পক্ষকে সমর্থন করা শত্রুতা বাড়ায়, ব্যবধান বৃদ্ধি করে। এর ফলস্বরূপ অবশেষে সাধারণ ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগকে দীর্ঘায়িত করে।
বিশ্বে মার্কিনরা এভাবে নিজের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে বারবার বিশ্বকে সংঘাতের দিকে নিয়ে গেছে। মার্কিনরা তাদের শক্তির অপব্যবহার এবং একতরফা নিষেধাজ্ঞা ইরানসহ অনেক দেশে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ২১ শতকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী নামে ৮৫টি দেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। যার ফলে সরাসরি কমপক্ষে ৯২৯,০০০ জন বেসামরিক জনগণের মৃত্যু হয়েছে এবং ৩.৮ কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্য যেকোনো মোড়ল দেশের চেয়ে বেশি একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং বর্তমানে এখনও ২০টিরও বেশি দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যার ফলে এসব দেশগুলোর জনগণের জন্য মৌলিক খাদ্য এবং ওষুধ সরবরাহ ও মানবিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবাদী দাসত্ব এবং শ্রম, দখল ও বন্টনের অসমতার উপর প্রতিষ্ঠিত। মার্কিনরা বিশ্বে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী।
গাজায় ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন (হামাস) এবং লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহ উভয়ে দ্বি-ফ্রন্ট সংঘাতের মূলে রয়েছে মার্কিনদের নিজের স্বার্থরক্ষার পদক্ষেপের ফল। মার্কিনদের নিজের স্বার্থরক্ষার পদক্ষেপের ফলাফলে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত একটি স্থায়ী, বিস্ফোরক ঐতিহাসিক অভিযোগ, আঞ্চলিক সংঘাত, নিরাপত্তা উদ্বেগ, নেতৃত্বের সমস্যা, বৈশ্বিক অংশগ্রহণ, মীমাংসা বৃদ্ধি এবং পক্ষগুলোর মধ্যে অসম্মান ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছে। ইসরায়েলের প্রতি ওয়াশিংটনের পক্ষপাতিত্বের কারণে ফিলিস্তিন এবং বৃহত্তর আরব বিশ্বের মধ্যে মার্কিন মধ্যস্থতার ক্ষমতার আস্থা কমে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন পদক্ষেপ, যেমন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সেখানে আমেরিকান দূতাবাস স্থানান্তর, একটি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের আলোচনায় পূর্ব জেরুজালেমের ভবিষ্য এবং ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসাবে সম্ভাব্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এতে ইহুদি জনগণের জন্য ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের জন্য ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে বা সম্ভাবনাকে ধ্বংস করেছে।
লেখক : কবি ও গবেষক