লালন যুগে নারী ছিল অবরুদ্ধ, চার দেওয়ালে বন্দি, অসূর্যস্পর্শা। নারী ছিল এক ধরনের দাসী। সাংসারিক কাজ-কর্ম করা, স্বামীর কাছে শোয়া আর সন্তান উৎপাদন এ ছিল নারীর কর্তব্য। তাঁর বাক স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন স্বাধীনতা ছিল না। এক কথায় তাঁর কোন অধিকার ছিল না। সে খাবার রান্না করত, কিন্তু সে পেটপুরে খেতে পারত না। পরিবারের সকলের খাওয়া শেষে যা উচ্ছিষ্ট থাকত, তাই সে খেত। তাঁকে মানুষ মনে করা হত না। পণ্য যেমন বস্তায় ভরে রাখা হয়, তেমনি নারীকে সে যুগে পর্দার নামে বস্তাবন্দি করে রাখা হত। সমাজে পর্দা প্রথার ন্যায় ছিল বাল্যবিবাহের প্রচলন। নারী শিক্ষা, নারী মুক্তি, নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা এ সব ছিল অকল্পনীয়। লালন নারীকে নারী হিসেবে নয়, নারীকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন। তিনি ছিলেন নারী স্বাধীনতায় বিশ^াসী। তিনি নারীকে পর্দা, হেজাব, চুরি, বালা, রুলি, মল, ঘোমটার মধ্যে, চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার ঘোরবিরোধী। সে যুগেই লালন নারী জাগরণের ডাক দিয়েছেন। নারীকে পর্দা প্রথা, অবরুদ্ধতা ভেঙে মানুষের কাতারে আসার আহবান জানিয়েছেন। লালন বলেন,
কুলের বউ হয়ে মনা আর কতদিন থাকবি ঘরে
ঘোমটা ফেলে চল নারে যাই সাধ বাজারে ॥
নারীর বাইরে বের হওয়ার প্রচলন ছিল না, অধিকারও ছিল না। কোনো বিশেষ প্রয়োজনে তিনি বের হলেও তাঁকে ছইওয়ালা গরুর গাড়ি বা ছইওয়ালা নৌকা বা পালকিতে যেতে হত। কারণ নারী যাতে যাওয়া-আসার পথে কিছু দেখতে না পান বা তাঁকে কেউ দেখতে না পায়। বদ্ধ গরুর গাড়ি, নৌকা বা পালকি থেকে উঠা-নামার সময়ও তাঁকে বড় ঘোমটা দিয়ে উঠা-নামা করতে হত। সে অবস্থায় লালন নারীকে ঘোমটা ফেলে পুরুষের ন্যায় চলাফেরা করতে, মানুষের কাতারে ফিরে আসতে আহবান করেছেন। সে যুগে এটি কম কথা নয়।
লালন নারী পুরুষে ভেদাভেদ বা লিঙ্গবৈষম্যে বিশ্বাসী নন। নারীও একজন মানুষ। পুরুষের মতো তারও ক্ষুধা আছে, দুঃখ আছে, আনন্দ আছে, বেদনা আছে, প্রেম আছে, কাম আছে, সাধ আছে। সুতরাং তাঁকে বঞ্চিত ও একপেশে করে রাখার অর্থ হয় না। এক বীজ থেকেই নারীপুরুষ সৃষ্টি হয়। নারীপুরুষ এক ফুলের দুইটি রঙ। এটা একটা সৃষ্টির লীলা, প্রকৃতির খেলা, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। নারী হল পুরষের সঙ্গী, পুরুষ হল নারীর সঙ্গী। নারী পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক। একজন ছাড়া অন্যজন অপূর্ণাঙ্গ। তাইতো লালন বলেন,
পুরুষ বলতে কুম্ভ ভারি এক বীজে হয় পুরুষ-নারী
বারিতে সৃষ্টি কারবারি এক ফুলে দুই রঙ ধরায়।
লালনযুগে নারী ছিল অন্দরমহলে বন্দি। পুরুষ তার স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে বের হত না, তাকে নিয়ে কোথাও যেত না। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কেউ বের হলে লোকে তাকে স্ত্রৈণ বলে উপহাস করত। স্ত্রীর সঙ্গে খেত না। বনের স্ত্রী পশুরাও নারীর চেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল। তারা পতির সঙ্গে একসঙ্গে খেতে পারত, ঘুরে বেড়াতে পারত। বনের পশুরা পারলেও সমাজের নারীরা তা পারত না। মনুষ্য সমাজের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে রাধিকার কতই না আকুতি ছিল! পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পশুর চেয়েও নিন্দনীয় ছিল। লালন রাধিকাকে নারীর প্রতিনিধিরূপে তুলে ধরেছেন। তাঁকে দিয়ে লালন সমাজকে বিদ্রƒপাত্মক পন্থায় বলেন,
বনেরও পশু যারা আমার থেকে ভালো তারা
সঙ্গে লয়ে থাকে আপন পতিরে
তারা এক সঙ্গে করে আহার পতির সঙ্গে করে বিহার
লালন বলে মজে থাকে আপন পিরিতে ॥
সমাজে নারীকে অবজ্ঞা করে নানা কটূক্তি করা হয়। তার মধ্যে একটি শব্দ হচ্ছে মাগী। নারী থেকে সবাই জন্ম নেয়, নারীর দুগ্ধ পান করে বড় হয়, নারীর কাছে সবাই যায়, তাঁকে সকলেই চায়, তারপরেও নারীর প্রতি অবজ্ঞার শেষ নেই। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, নারী ছাড়া জীবন পার করতে পেরেছেন এমন মহামানব কয়জনা? লালন নারী অবজ্ঞার জবাবে বলেন,
কারে বলছো মাগী মাগী
তারে বিনে তরাইতে পারে
কোন সে মহাযোগী ॥
সন্তান প্রজননে, উৎপাদনে, লালন-পালনে নারীর ভূমিকা তুলনাহীন। নারীর উদরে জন্ম নিয়ে, নারীর দুগ্ধ পান করে নারীকে অবমাননা এ যেন এক অমানবিক ভাবনা। সন্তানের উপর মায়ের কর্তৃত্ব থাকা উচিত। মায়ের পরিচয়ে সন্তানের পরিচিতি হওয়ার কথা। বাবা নন, মা সন্তানকে উদরে ধারণ করেন। প্রকৃতিতে প্রাণি তথা পশু-পাখির পরিচিতি পায় মা অনুয়ায়ী, পিতা অনুযায়ী নয়। গরু, ছাগল, হাতি, ঘোড়া, হাঁস, মুরগি, কুকুর, বিড়াল প্রভৃতির পরিচিতি মায়ের পরিচয়ে, বাবার পরিচয়ে নয়। জন্মের সময় প্রাণির বাবা কোথায়, তার ভূমিকাইবা কী? তাহলে মানুষ কি প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে? তাই লালন বলেন,
যখন তোমার জন্ম হইলো বাবা তখন কোথায় ছিলো
কার সঙ্গে মা যুগল হলো কে তোমারে জন্ম দিলো ॥
সন্তানের কাছে মাতা দৃশ্যমান, কিন্তু পিতা নন। প্রকৃত পিতার পরিচয় মাতাই দিতে পারেন, অন্য নয়। মা ছাড়া কে দিতে পারে পিতার সন্ধান? তাই মাতার ভজনা করলেই মিলবে পিতার পরিচয় ঠিকানা। মা হচ্ছেন কেন্দ্রবিন্দু, তাঁকে কেন্দ্র করেই সব। তাই মাকে ভজনা করলে সব সত্য জানা যায়। লালন বলেন,
নিগুঢ় বিচারে সত্য তাই গেলো যে জানা
মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা॥
অনেকে আছেন পিতামাতা, সংসার ত্যাগ করে, সাধুর বেশ ধরে, সাদা কাপড় পড়ে আশ্রমে আশ্রমে ঘুরে বেড়ায় পরম মানুষের সন্ধানে। লালনের দৃষ্টিতে যারা পিতামাতাকে ত্যাগ করে তাদের আবার ধর্ম কী? তারা ধর্মের মর্ম জানে না। তিনি তাদেরকে সাধুর বেশ ভূষা ছেড়ে মাকে ভক্তির কথা বলেছেন, মায়ের নির্দেশ পালনের কথা বলেছেন। আগে ভজ মায়ের চরণ তবে পাবে গুরুর দরশন। তিনি বলেন,
ত্যাজ্য করে পিতামাতা কী ধর্ম আজ জানবি কোথা
মায়ের কথায় চল কৌপিন খুলে ফেল
লালন কয় যেরূপ তোর মায়ে কয়রে ॥
নারী হচ্ছে আলো বা শক্তিস্বরূপ। নারীই সব জ্ঞান ও সৃষ্টিকর্মের মূলকেন্দ্র। সাধকগণ গুরুকে মাশুক, সখি বা নারীরূপে ধ্যান করেন। নারীস্বরূপ গুরু ভজনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় মহাপুরুষ। তাই সৃষ্টির মূলাধার হচ্ছে নারী। লালন তাঁকে আদি ইমাম বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন,
দশ দুয়ারি মানুষমক্কা মোর্শেদপদে ডুবে থাকগা ধাক্কা সামলিয়ে
ফকির লালন বলে গুপ্তমক্কায় আদি ইমাম সেই মেয়ে ॥
আদি ইমাম হচ্ছে শ্রদ্ধেয় নারী। এভাবে লালন সৃষ্টির আঁধাররূপে নারীকে মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁকে সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছেন। পুরুষ ধর্ষক হলে সমস্যা নেই। পুরুষ মানুষ দু’একটু ওরকম করেই থাকে। সমস্যা হয় নারীর। পুরুষ নারীর কাছে আসে, আবার পুরুষই নারীর কুৎসা রটে বেড়ায়। নারীকে বেশ্যা বলে গালি দেয়। লালন বেশ্যাকেও মানুষ হিসেবে দেখেছেন। বেশ্যাবৃত্তিও হতে পাওে একটি পেশা। এর সাথে ধর্ম বা জাত যাওয়ার সম্পর্ক কী? লালন বলেন,
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয় এ ভ্রম তো গেলো না ॥
বাউলদের অনেক সময় নর-নারীর অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। যারা এ অভিযোগ করেন তারা না ভেবেই করেন। বাউলরা কি কোন নারীকে ধর্ষণ করে বা করেছে? এমন নজির আছে? অথচ সমাজের কোন শ্রেণির মধ্যে ধর্ষক নেই? পত্র-পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে কারা ধর্ষক? সে তালিকায় মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে গির্জার পাদ্রি, কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্রালয়ের শিক্ষক, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, হিন্দু, মুসলমান সবাই আছেন, কম আর বেশি। বাউল দর্শনে ধর্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা নেই। বাউল দর্শনে আছে প্রেম, আনন্দ। উভয়ের সম্মতিতে যা হয় তাই প্রেমানন্দ। জোর করে প্রেমানন্দ হয় না, সঙ্গমও হয় না, তা হয় ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংস আচরণ। লালন নারীর প্রতি সহিংস আচরণের ঘোর বিরোধী। লালন বলেন,
পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করো না পারে যেতে পারবে না
যতোবার করিবে হরণ ততোবার হবে জনম ॥
লালনের বিভিন্ন গানে বিভিন্ন নারী চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। যেমন- মা আমেনা, ফাতেমা, যশোদা, রাধা, সুভদ্রা, দেবকী, গোপী, রাইকিশোরী, চন্দ্রাবলী, বিন্দে, লক্ষ্মী, সরস্বতী, বোষ্টমী প্রমুখ। নারীকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসার জন্যে তিনি তাঁর গানে এতোসব নারী চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। একটি জাতির বা দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা হচ্ছে নারী। অর্ধেক জনসংখ্যাকে ঘরে আবদ্ধ রেখে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। নারীও দেশ ও জাতির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। সাম্যের কবি লালন নারীকে ঘরকুনো কুলের বউ থেকে উঠে এসে সমাজ উন্নয়নে, দেশ ও জাতি গঠনে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর