আমার সনাতন ধর্মাবলম্বী বন্ধু বিকাশ, আশিক, আশিষ এরা যখন পুজোর ছুটিতে স্কুল বন্ধ হলে আনন্দে মেতে উঠত। তখন আমরা মুসলমান পরিবারের সন্তানরা একইভাবে আনন্দে মেতে উঠতাম কলকাতা দেব সাহিত্য কুটীর থেকে প্রকাশিত মোটা মোটা আনন্দ বার্ষিকীগুলো হাতে। বলছি, ষাটের দশকের কথা; যখন পূজাসংখ্যাগুলো ছিল শিশুতোষ মনোবাঞ্ছা পূরণের খোরাক। পুজোর ছুটি যখন শেষ, দেখা যেত বিকাশরা নতুন জামাকাপড় বা খাবারের গল্প করছে আর আমি হয়তো শিবরাম চক্রবর্তীর ‘হাসির অ্যাটম বোম’-এর কথা বলছি। দেব সাহিত্য কুটীর এখনও বার্ষিক পূজাসংখ্যাগুলো বের করে কি-না, জানি না। ঘরে ঘরে এ আশ্চর্য সংখ্যাগুলোও আর দেখিও না।
দুর্গাপূজার মা দুর্গার সম্মোহনী মূর্তির প্রতি ছোটবেলা থেকে আকর্ষণ বোধ করতাম। কী সুন্দর চোখ টানা টানা, কী সুন্দর নাক, কী সুন্দর ঠোঁট, কী সুষম গঠন! একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী সন্তানের কাছে মা দুর্গার প্রতিমা মায়ের মতোই, কিন্তু একজন অ-হিন্দু সন্তানের কাছে মা দুর্গার প্রতিমা দেবীর প্রতিভূ ছাড়াও তার মানসসুন্দরীর প্রতিমাস্বরূপ প্রতিভাত হতে পারে। ধর্মের বা ধর্মের বাইরের আবেদনের প্রতি অনেক সময় আমাদের বিস্মৃতি নিতান্তই বিভ্রান্তমূলক। ধর্মীয় উপাসনালয়ের মিনার এবং গম্বুজ যেমন ধর্মের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, শৌর্য-বীর্য প্রচার করছে, তেমনি স্থাপত্যশিল্পের দিক থেকে এগুলোর নির্মাণ প্রকৌশলীর গোড়া বা উৎস যে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের প্রতিফলন এটি একটি স্বীকৃত প্রতিপাদ্য। উদাহরণ হিসেবে তাজমহলের প্রসঙ্গটি আনা যায়। একান্ত ধর্মীয় অর্থে বললে তাজমহল সৌধটি বিবি মমতাজের মাজার বা মসোলিয়াম। কিন্তু তাজমহলের আজকের স্বীকৃতি বিশ্বনন্দিত অমর স্মৃতিসৌধ হিসেবে। যার সৌন্দর্য শেকসপিয়ারের ক্লিওপেট্রার রূপ বর্ণনার ভাষায় বলতে হয়, ‘যত তারে দেখি, তৃষ্ণা মিটে যাওয়ার বদলে তৃষ্ণা আরও বাড়তে থাকে।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/ এ তাজমহল।’
ক্লিওপেট্রার কথাটা আসাতে ভালোই হলো। ধর্মের বাতাবরণের আরেকটি গূঢ় ইঙ্গিত হলো, প্রকৃতি এবং মানুষের সৃজনশীলতার মধ্যে যে সম্পর্ক তার মধ্যেই ধর্মীয় বক্তব্য বিন্যাসিত হওয়া। প্রাচীন গ্রিকদের গ্রন্থভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ছিল না। তাদের ছিল হাজারো দেব-দেবী, যাদের পুজো করে তারা আধ্যাত্মিক প্রশান্তি পেত। অর্থাৎ ধর্মের বিভিন্ন অভিব্যক্তি যেমন অদৃষ্টবাদ, প্রশ্রয়বাদ, সমাধানবাদ ইত্যাদি বক্তব্য তারা দেব-দেবীকে পূজা করার মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করত। তাদের রূপময়ী দেবী ছিলেন ভিনাস। ভিনাসের মূর্তি কিংবা ছবি ছিল প্রকৃতির চেয়ে যে শিল্প সুন্দর তার একটি প্রমাণ। কিন্তু শেকসপিয়ার করলেন কী, তিনি ক্লিওপেট্রার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, ভিনাসের মূর্তি বা ছবির চেয়েও ক্লিওপেট্রা ছিল সৌন্দর্যে ভরপুর : ‘ওভার-পিকচারিং দ্যাট ভিনাস’। প্রকৃতির চেয়ে শিল্প সুন্দর, কিন্তু শেকসপিয়ারের মতে, শিল্পের চেয়েও প্রকৃতি সুন্দর হতে পারে যার প্রমাণ ক্লিওপেট্রা।
ধর্মের বিরাট রহস্য এ জায়গাটাতেই লুকায়িত। তাই আমি মনে করি প্রকৃতি এবং মানুষের আধ্যাত্মিক খোঁজের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটি নির্ধারণ করার চেষ্টাতেই ধর্মীয় চিন্তা ব্যাপৃত। মানুষ প্রকৃতির মধ্যে অপার শক্তি খোঁজে (সূর্য-তপস্যা, বৃক্ষ-পূজা ইত্যাদি), মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণেও আনতে চায় এবং সর্বোপরি মানুষ ধর্মকেও মানবিক আচার-আচরণের মধ্যে ধারণ করে বুঝতে চায় কীভাবে ধর্মের গূঢ়তম উপলব্ধিতে পৌঁছানো যায়। এ ব্যাপারে মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ মহাকাব্যের কথা বলতে পারি। মিল্টন আদম ও ইভকে প্রথম মাতাপিতা হিসেবে শ্রদ্ধা, প্রণাম, ভক্তি ইত্যাদি দিলেও তিনি পুরো মহাকাব্যে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছেন যে, ‘আদম ও ইভ সংসারের আর দশটা দম্পতির মতোই ছিলেন, মিলন ও বিরহে। স্বর্গ থেকে বহিষ্কারের পর তাঁরা পৃথিবীতে নামছেন হাত ধরাধরি করে, নিঃসঙ্গ ও একাকী।’ স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাটের মতে, সেদিন থেকে আদম ও ইভ প্রকৃত মানুষে পরিণত হলো।
তাই দেবী মা দুর্গার মূর্তি দেখে একদিকে যেমন মায়ের সর্বংসহা ও ক্ষমতাময়ী রূপ মনে পড়বে তেমনি দেবীর স্নিগ্ধ মায়াবী চেহারায় আমি আমার মাকে দেখি। দেখি আমার কন্যার রূপ। মা দুর্গার দশ হাত এবং এক পায়ের নিচে নিবৃত হচ্ছে অসুর। মায়ের এ ক্ষমতা সম্পর্কে সনাতন ধর্মের এ চিরজাগরূক প্রত্যয় আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। প্রতীকী অর্থে আমরা সবাই মায়ের আশীর্বাদ পেয়ে জীবনের দশদিকে যুদ্ধ করে যাচ্ছি, দলন করে যাচ্ছি মনের ভেতরের অসুরকে নিত্য। মা-ই আমাদের ভয় হতে তব অভয় মাঝে নতুন জনম দিচ্ছেন। অসুররা এই সমাজে আগেও ছিল এখনও আছে। এই অসুররা সমাজের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের কারণ সৃষ্টি করে। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-মৈত্রীর সেতুবন্ধনে বাদ সাধে। অসুর শক্তি যেকোনো দৃষ্টিতেই নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য। অসুররা যে পর্যন্ত বিনাশ না হবে সেই পর্যন্ত আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত সমাজ পাব না।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধপর্ব আমাদের একসুতায় বেঁধেছিল। তখন ধর্মীয় পরিচয় নয়, জাতিগত পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। অগণিত মুক্তিকামী মানুষের আকাক্সক্ষা এবং সংগ্রাম তখনও রুখে দিয়েছে অসুরশক্তিকে। এই অসুররা শুধু প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করেনি, প্রাণসংহারেও মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মুখ্য প্রত্যয়। বৈষম্যের ছায়া ছড়িয়ে সম্প্রীতির আলো ছড়িয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রগতিবাদী সব শক্তিকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। আমরা উচ্চারণ করছি, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। এই উচ্চারণের প্রতিফলন সমাজে যাতে আলো ছড়ায় এই লক্ষ্যেও আমাদের প্রচেষ্টা অবিরত জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এই সত্যও অস্বীকারের পথ নেই, সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে অসুররা বায়ান্ন বছরের এই বাংলাদেশে কম অপতৎপরতা চালায়নি। এখনও যে তারা নিষ্ক্রিয় নয় তা-ও সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। কিন্তু আমাদের শক্তির উৎস হলো বাঙালি সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতির আলো অত্যন্ত উজ্জ্বল। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বাংলাদেশ এক অর্থে এক বিশাল সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। একদিকে এর আছে সনাতন ধর্মের সংস্কৃতিবাদ, অন্যদিকে ইসলামের অপার অধ্যাত্মবাদ এবং তৃতীয় সুর হিসেবে আছে গৌতম বুদ্ধের অহিংসবাদ। সেজন্যই বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব পৃথিবীর অন্যতম সমন্বয়বাদী দেশ হিসেবে পরিগণিত হওয়া। এই বিশ্বাস ধারণ করেই আরও শক্তি সঞ্চয় করে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ও নেতৃত্বে একাত্তর তো বটেই, একাত্তরের পূর্বাপরও সম্প্রীতি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার নিরন্তর লড়াইয়ের যে সড়ক নির্মাণ হয় তা ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে চলা আরও বেগবান হোক। সনাতন ধর্মাবলম্বীর সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক