সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫ ৮ বৈশাখ ১৪৩২
সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫
জীবনানন্দ ও বনলতা সেন
রেজাউল করিম
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩, ৩:৩৭ PM আপডেট: ২৭.১০.২০২৩ ৩:৪৫ PM
বনলতা সেন কবিতায় ইতিহাস, ভূগোল, প্রেম, নারীর সৌন্দর্যের বর্ণনা, সান্ধ্যকালীন প্রকৃতি ও কবির অন্তিম অবসর জীবনের বর্ণনা স্থান পেয়েছে। কবিতাটিতে তিনটি স্তাবক। একেক স্তাবকে কবির একেকটি কল্পনা স্থান পেয়েছে। 

প্রথম স্তাবক :
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন। 

প্রথম স্তাবকে পাওয়া যায় কবির ক্লান্তিময় ভ্রমণকাহিনী। কবি হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছেন মানে এক হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছেন তা নয়। কবি হাজার হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছেন। কবি কি তাহলে হাজার হাজার বছর বেঁচে ছিলেন? না, মোটেই না। কবি হাজার হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটছেন, ইতিহাস ঘেঁটে বহু দেশ, সাগর পাড়ি জমিয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি বিম্বিসার, অশোকের ধূসর জগতে গিয়েছেন। বিম্বিসার ও অশোকে জগতকে কবির কাছে ধূসর বা আবছা মনে হচ্ছে। কেননা তাঁরা অনেক আগের রাজা-সম্রাট। বিম্বিসার হচ্ছেন ভারতে মগধ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৫ খ্রিস্টপূর্ব ৪৯২ অব্দ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন। ইতিহাসে তাঁর পূর্বে ক্ষমতাধর কোন রাজা বা সম্রাটের নাম জানা য়ায় না। আর অশোক দ্য গ্রেট ছিলেন ভূবন বিখ্যাত সম্রাট। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮-২৩২ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। 

এরপর কবি গিয়েছেন আরো দূরে, বিদর্ভ নগরে। ভারতের মধ্য প্রদেশের বর্তমান বিদরের প্রাচীন নাম বিদর্ভ। দূর-দূরান্তের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন মানে ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সমুদ্র সফেন জীবনের চরিদিক ঘিরে ফেলেছে। সফেন মানে ঢেউ বা তরঙ্গ। মুক্তির কোন পথ নেই। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস ঘেঁটে, বহু স্থান পরিভ্রমণ করে কোথাও শান্তি মেলেনি। অবশেষে একটু শান্তি পেলেন নাটোরের বনলতা সেনের কাছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, নারীর কাছে মেলে আনন্দ, স্বস্তি। নারী হচ্ছে প্রকৃতি ও সহজিয়া আনন্দের আধার। নারীই পারে পুরুষের ক্লান্তি দূর করতে। নারীর কাছেই পুরুষ পায় আনন্দ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা। 

দ্বিতীয় স্তাবক :
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। 

দ্বিতীয় স্তাবকে কবি বনলতা সেনের নান্দনিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন। কবি বনলতা সেনের চুলকে তুলনা করেছেন অন্ধকার বিদিশার নিশার সঙ্গে। বিদিশা হচ্ছে প্রাচীন ভারতের মালব অঞ্চলের একটি নগরী। মালব হচ্ছে আজকের গুজরাট রাজ্য। নিশা মানে রাত। অন্ধকার নিশা মানে কালো রাত। চুল কালো মানে কচি চুল, সুন্দর চুল। চুল যতো কালো ততোই ভালো। এজন্য কবি বনলতা সেনের চুলকে বিদিশার অন্ধকার রাতের সাথে তুলনা করেছেন। কবি তার মুখাবয়বকে শ্রাবস্তীর কারুকার্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শ্রাবস্তী প্রাচীন কোশল রাজ্যের এক সমৃদ্ধশালী অপূর্ব সুন্দর নগরীর নাম। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারত ১৬টি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। কোশল ছিল তাদের একটি। তাই কবি সমৃদ্ধ ও সুন্দর নগরী শ্রাবস্তীর সঙ্গে বনলতা সেনের মুখের চেহারার তুলনা করেছেন। গভীর সমুদ্রে জাহাজের হাল ভেঙ্গে গেলে নাবিক দিক হারা হয়ে যান। নাবিক হতাশায় নিমজ্জিত। কীভাবে মুক্তির পথ পাবেন সে চিন্তায় বিভোর হয়ে যান। 

এমন সময় দেখা মিলল সবুজ ঘাসের দারুচিনি দ্বীপের। পথহারা থেকে পথের সন্ধান পেলেন নাবিক। কবিও তদ্রুপ বনলতা সেনের দেখা পেয়ে বাঁচার স্বাদ পেলেন। পাখির বাসা যেমন পাখির আশ্রয়স্থল, বনলতা সেনের চাহনির মধ্যে কবি আশ্রয় পেয়েছেন। বনলতা সেন আশ্রয়ময় চোখ দুটো মেলে কবির কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’ দিকহারা নাবিক যেমন সমুদ্রে দারুচিনি দ্বীপের দেখা পেয়ে দিক খুঁজে পেলেন, সম্পদের সন্ধান পেলেন, বেঁচে থাকার আনন্দ পেলেন, তেমনি ক্লান্ত- শ্রান্ত, আনন্দহীন কবি বনলতা সেনের দেখা পেয়ে, তার আশ্রয়ময় চোখের চাহনি দেখে এবং সর্বোপরি এতোদিন কোথায় ছিলেন এ জিজ্ঞাসা শুনে পুলকিত হয়েছেন, বেঁচে থাকার আনন্দ, সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন।































তৃতীয় স্তাবক :
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। 

তৃতীয় স্তাবকে রয়েছে অন্তিম জীবনের অবসর সময়ের বর্ণনা। দিনের শেষে শিশির এ সময়টা হচ্ছে হেমন্তকাল। হেমন্তকালে সন্ধ্যায় শিশির পড়ে। চিল খাবারের সন্ধানে সারাদিন রোদে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যায় তার ডানায় রোদের গন্ধ পাওয়া যায় না। এখন তার নীড়ে ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার পালা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে পাখি সব নীড়ে ফেরে। নদীর কোলাহল বন্ধ হয়ে যায়। নদীই ছিল সে সময় যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যম। সন্ধ্যা হলে তা বন্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীর সব রং মানে সব আলো নিভে যায়। রাতে জোনাকির আলোর একটু দেখা মেলে। ফুরিয়ে আসে জীবনের লেনদেন। কবির সামনে তখন অন্ধকার। সে অন্ধকারে তার সঙ্গে আছে শুধু বনলতা সেন।

পাখি নীড়ে ফেরে যেমন স্বস্তি পায়, কবিও তেমনি বনলতার কাছে ফিরে স্বস্তি পান। তার সঙ্গে কবি জুড়ে দেন গল্পের আসর। তদ্রুপ বার্ধক্য ঘনিয়ে এলে মানুষের কর্মব্যস্ততা, দেনা-পাওনা হ্রাস পায়। তখন মানুষ ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে। এ সময়ে মানুষের মনে নানা স্মৃতি ভেসে উঠে। মানুষের বয়স যতো বৃদ্ধি পায়, স্মৃতির পাতা ততো দীর্ঘ হয়। প্রিয় মানুষের স্মৃতি হলে তো কথা নেই! বুড়ো বয়সে অবসর জীবনে মানুষ গল্পের আসর জমাতে পছন্দ করে, যেন গল্পের পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসে। 

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে- কে এই বনলতা সেন? কারো মতে, বনলতা সেন হচ্ছে প্রকৃতি বা নারীর প্রতীক। জন্মলগ্ন থেকেই মানুষ নারী আর প্রকৃতির কাছে শান্তি খুঁজে পায়। কবিও হাজার হাজার বছরের অবিরাম সন্ধান শেষে বনলতা সেনরূপী নারী অথবা প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করে স্বস্তি পেয়েছেন।

ভূমেন্দ্র গুহের কাছে জীবনানন্দ দাশের ডায়েরি রাখা আছে। সে ডায়েরিতে লিটারেরি নোটস্ হিসেবে ণ নামে এক মেয়ের নাম লেখা আছে। তাতে তিনি লিখে রেখেছেন শচী। ডায়েরির অন্যান্য পৃষ্ঠা বিবেচনায় ভূমেন্দ্র গুহ বলেছেন, জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন শোভনার প্রতি কবি দুর্বল ছিলেন। এ শোভনাই হচ্ছেন ওয়াই বা শচী বা বনলতা সেন। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ কবি এই শোভনা মজুমদারকে উৎসর্গ করেছেন। কবি হিসেবে উপেক্ষার অনেক কঠিন সময়ে জীবনানন্দের কবিতার মুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন শোভনা। দরজা বন্ধ করে প্রায়ই কবি শোভনাকে কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। ভূমেন্দ্র গুহের মতে, শোভনাকে উদ্দেশ্য করে জীবনানন্দ বনলতা সেন কবিতা লিখেছেন যা নিছক প্রেমের কবিতা। 

অশোক মিত্রের মতে, কবি বনলতা সেন নামটি পত্রিকা থেকে ধার করেছিলেন। সে সময় নিবর্তক আইনে বনলতা সেন নামে এক নারী রাজশাহী জেলে বন্দিনী ছিলেন। এ বনলতা সেন পরে কলকাতার কলেজে গণিতের শিক্ষকতা করতেন। বনলতা সেন রচনার পঁচাত্তর বছরপূর্তিতে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে অশোক মিত্র জানাচ্ছেন, তিনি নিজে কবি জীবনানন্দ দাশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ‘বনলতা সেন’ কে? 

কবি এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব দেন নি। শুধু বলেছেন, বনলতা সেন নামটি পেয়েছিলেন পত্রিকা থেকে।

লেখক : লালন গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত