সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫ ৮ বৈশাখ ১৪৩২
সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনা আজও প্রাসঙ্গিক
ড. মো. শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩, ৩:৪০ PM
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য একটি অনন্য, অতুলনীয় অর্থনৈতিক দর্শনও রেখে গেছেন। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের নতুন সংবিধানে তিনি তখন দারিদ্র্য বিমোচনের চমৎকার দিকনির্দেশনা রেখে গেছেন। গরিব-দুঃখী সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রতিশ্রুতি পালনে তিনি ছিলেন নির্ভীক। গ্রামের মেহনতি কৃষক যারা রোদে পোড়া ও বৃষ্টিভেজা মাঠে ফসল ফলিয়েছিল তদের কল্যাণে বঙ্গবন্ধু সচ্চার ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে, কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হওয়ার পর আজও আমরা সাম্যতার সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। তাই বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন আজও খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। তাঁর চিন্তা ও চেতনায় দেশের স্বাধীনতার সাথে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি সর্বদা ছিল প্রধান বিষয়বস্তু। অবহেলিত, নিপীড়িত, শোষিত, পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপগুলো ছিল প্রশংসনীয়। তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্তে দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি প্রকাশ পেতে শুরু করে, আজও জাতি তাঁর কথা স্মরণ করে। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। স্বাধীনতার পর গৃহীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য খাতভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ করেছিল। ঐ সময়ে প্রণীত বাজেটে কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের জন্য যে পরিমাণ উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গবন্ধু সরকার কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। যার ফল আজও দেশ ভোগ করেন। কারণ কৃষিতে যে উন্নয়ন তা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণ করে সম্ভব হয়েছে। দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতিকে উন্নয়নের পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য জাতীয় উন্নয়ন নীতিতে এই উভয় খাতকে গুরুত্ব দেওয়া ছিল। কারণ স্বাধীনতার পর কৃষি খুব বিপর্যস্ত ছিল।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। প্রায় কোনো পরিবারই খাজনা মওকুফের সুবিধা থেকে বাদ পড়েনি। কৃষিতে উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল তৈরি করেন। পাটের অর্থনৈতিক গুরুত্ব দেওয়ার জন্য পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন।  

এরপরও বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য ছিল না। তাই দেশীয় সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার এবং উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন অবিলম্বে সম্ভব ছিল না, তবে বঙ্গবন্ধু বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর না করে একটি সফল ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যা আজও দৃষ্টান্ত। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কাঠামোতে যে বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা হলোÑ জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বোচ্চ জনকল্যাণ নিশ্চিত করা। যা আজ অনেক দেশের উন্নয়নে প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, দেশের মানুষ গরিব থাকলে দেশও গরিব হবে। তাই মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারলে দেশ ও জাতি সমৃদ্ধ হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর অর্থনীতির দর্শনে সম্পদের সুষম বণ্টনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। যা মানব উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দারিদ্র্য বিমোচনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যান যে মানুষটি তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সরকারি সেবা সমাজের সকল মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, নারী জাগরণ ও ক্ষমতায়ন কর্মসূচির প্রসার বঙ্গবন্ধুর অবদান অতুলনীয়। সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে তিনি নানামুখী যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, সামাজিক সূচকে কিভাবে অগ্রগতি অর্জন করা যায়, কীভাবে মানবসম্পদের উন্নয়ন করা যায় বঙ্গবন্ধু সর্বদা এসব নিয়ে চিন্তা করতেন। বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শিল্প, কলকারখানা, খেতে-খামারে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীনতার পর প্রতিবছর গড়ে ২০-৩০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করা ছিল তখন অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই আমদানি সব সময় সহজসাধ্য ছিল না। সেজন্য তিনি কৃষির উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি করার জন্য ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন। 

দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া পদক্ষেপ শুধু আমাদের দেশেই প্রাসঙ্গিক নয়,অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য আজও অনুকরণীয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্বাসনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সরকার নতুন অবকাঠামো নির্মাণের চেষ্টা করেন। সীমিত সম্পদের অধিক ব্যবহারের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞাময় ও সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনা আজও দেশের মানুষ স্মরণ করে।  

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কঠিন কাজ শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সকল জটিল চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলা করেছেন। এ সময় তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের সব নীতিই দেশের মানুষের স্বার্থকে নিয়ে গ্রহণ করা হত। বঙ্গবন্ধু কঠোরভাবে প্রশাসনকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।  তিনি বলতেন দেশের স্বার্থ সবার আগে। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আজও বিরল, যা বর্তমান সমাজ প্রেক্ষাপটে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর দৃঢ় মনোভাব যে কোন কঠিন বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে, যে কারণে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাই দেশীয় সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার এবং উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া আরও বেশি প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন কিভাবে করা  যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কিভাবে বাড়ানো যায় সেই বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল কৃষি খাতের পুনর্গঠন ও উন্নয়ন। সর্বদা মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ, বাংলার কৃষকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। রাজনীতি ও দেশের উন্নয়নের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক জায়গায় গেছেন। তিনি কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের কাছ থেকে অকৃত্রিম ভালোবাসা, আন্তরিক স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক দর্শন সম্পর্কে যেসব বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন, যেমন-১) গরিবের কল্যাণ : বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি দর্শনে গরিবের কল্যাণ প্রধান গুরুত্ব পায়। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিকভাবে গরিব জনগণের কল্যাণে মনোনিবেশ করেন। তিনি বাংলাদেশের গরিব লোকদের জীবন স্তর উন্নত করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালানোর প্রতি বদ্ধপরিকর ছিলেন। ২) স্বাধীন অর্থনীতি : বঙ্গবন্ধু স্বাধীন অর্থনীতির প্রশংসা করেন। তিনি দেশের আর্থিক স্বাধীনতা ও নির্ভরতা স্থাপনে মনোনিবেশ করেন, এবং বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করেন। তিনি দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং নির্ভরতা নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নতি সহায়ক করার দিকে মনোনিবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি এবং উদ্যোগশীলতাকে বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিসাধনের জন্য উৎসাহিত করেন। তিনি স্বদেশের উদ্যোগশীল প্রতিষ্ঠানের সৃজনশীলতা, নতুন প্রযুক্তি এবং উৎপাদনের সমর্থন করেন। ৩) কৃষি : বঙ্গবন্ধুর দর্শনে কৃষি প্রতিষ্ঠান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক গুরুত্ব প্রয়োগ করা হয় হয়, যা কৃষকদের জীবনযাপন সমৃদ্ধ করে এবং খাবার নির্মাণে সাহায্য করে। ৪) শিক্ষা,অর্থনীতি ও ব্যবস্যা : বঙ্গবন্ধু শিক্ষার উন্নয়নের স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু ব্যবসায়িক উন্নতি এবং স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ সৃষ্টি করেন, যাতে একটি স্বাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন হতে পারে। বঙ্গবন্ধু উদ্যোগশীল প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা করার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে আর্থিক ক্ষমতা বাড়াতে মানুষকে প্রেরণা দিতেন। বঙ্গবন্ধু একটি সৎ এবং নৈতিক আর্থনীতি স্থাপনের প্রশংসা করেন, যাতে কোনও দুর্নীতি না হয়। বঙ্গবন্ধু দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং স্বাধীন অর্থনীতির মাধ্যমে দেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নতি করার উদ্দেশ্যে কাজ করতেন। বঙ্গবন্ধু শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সর্বদা কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু দেশের আর্থিক সম্প্রসারণ এবং বিশেষভাবে গ্রামীণ অঞ্চলে আর্থিক সেবা বাস্তবায়নের কথা মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন।  

সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন ছিল একটি ব্যাপক, মানবিক, এবং সমাজের কল্যাণে মনোনিবেশ করা দর্শন, যা দেশের অর্থনীতি এবং সমাজের উন্নতির দিকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তাঁর চিন্তা-ভাবনায় গরিবের কল্যাণ, স্বাধীন অর্থনীতি, কৃষি ও শিক্ষার প্রস্তাবনা, সমাজবাদ, সম্পত্তির সমান বণ্টন এমন অনেক মৌলিক দিকে মনোনিবেশ করে দেশ পরিচালনা করেছেন যা আজও খুবই প্রাসঙ্গিক।
 
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত