বাংলাদেশের রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মূলত আমাদের রাজনীতির ক্রান্তিকাল পার করছে। এমন একটি সময়ে আমরা আছি যখন বিশ্ব পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি উঁচু জায়গায় সমাসীন হয়েছে; বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে আমরা সক্ষম হয়েছি।
অপরদিকে, ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে আমরা বাংলাদেশ বিশ্ব মোড়লদের কাছে অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এমন স্বকীয় ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং দেশের অপার সম্ভাবনা ও টেকসই উন্নয়নের কারণে বিশ^পরিমণ্ডলে অনেকের মধ্যে গাত্রদাহ হতে পারে। অনেকেই বাংলাদেশকে তাদের প্রভাব বলয়ে রাখতে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে, স্বাধীনতাবিরোধীদের দিয়ে সহিংসতা সৃষ্টি করছে, নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং সংবিধানের সুস্পষ্ট নীতিমালাকে পদদলিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এমন অপকর্ম সাধনে বিএনপি-জামায়াতের মতো সাম্প্রদায়িক ও সহিংস দলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে, সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপি-জামায়াত মরিয়া হয়ে উঠেছে।
দুই.
গত ২৮ অক্টোবর ২০টি শর্তে বিএনপিকে নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের অনুমোদন দেয় পুলিশ। কিন্তু বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা বলে আগুনসন্ত্রাস, সহিংসতা ও ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে ফের সহিংস রাজনীতিতে ফিরেছে। পুলিশের ওপর বর্বর হামলা চালায় বিএনরি কর্মী-সমর্থকরা। ফলে পুলিশসহ সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিএনপি স্থাপনা ও যানবাহনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে দিনভর তাণ্ডব চালায়। দলটির নেতাকর্মীরা সেই শর্ত ভঙ্গ করে আবার সহিংসতার পথ বেছে নেয়। পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায় বিএনপির নেতাকর্মীরা। নয়াপল্টনের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পরে কাকরাইল, সেগুনবাগিচা, হাইকোর্ট এলাকা, পল্টন থেকে বিজয়নগর পর্যন্ত সমস্ত এলাকায় বিএনপি অগ্নিসন্ত্রাস করে ত্রাস সৃষ্টি করে। সাংবাদিক ও পুলিশসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর করে। সমাবেশের নামে প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও হামলা চালানো হয়েছে। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল ও জাজেজ কমপে¬ক্সে আগুন দেয় তারা। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ও আইডিইবি ভবনের গাড়িতে আগুন এবং ভবনে হামলা চালানো হয়েছে। পুলিশ বক্স ভাঙচুর ছাড়াও খিলগাঁও বিশ্বরোড, কাকরাইল, রমনা পার্কসংলগ্ন এলাকা, মগবাজার, মৌচাক ফ্লাইওভারের ওপরে, কমলাপুর রেল স্টেশন এলাকায় একাধিক বাস, পিকআপ ভ্যান, মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। আগুন দেয়া হয় শাহজাহানপুরে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িতেও। বিএনপির সহিংসতা বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি কঠোর হত, তাহলে অনেক প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল। তাদের ধৈর্যের কারণেই বিএনপির সহিংসতার মাত্রা তীব্র ছিল এবং পুলিশের এক সদস্যকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সেদিন পুলিশ সদস্যরা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে বিএনপির প্রতি সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়েছেন।
অপরদিকে, গত ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে হাজির হলেন নতুন অবতার! মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভুয়া উপদেষ্টা মিয়ান আরিফ। যা ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস বিবৃতি দিয়ে জানাল মিয়ান আরেফি জো বাইডেনের উপদেষ্টা নন। বিএনপি নেতাদের মিথ্যাচার আর ষড়যন্ত্র এমনটা পর্যায়ে চলে গেছে ভাবতে খুবই অবাব লাগে। এদেশের জনগণের ওপর বিএনপির আস্থা নেই; তারা বিদেশি প্রভুদের ওপর নির্ভর করে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতায় আসতে চায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। প্রশ্ন হল মার্কিন মুলুকে বসবাস করা এ উপদেষ্টা কীভাবে বিএনপির পক্ষে ভূমিকা পালন করে? ব্যপারটি এদেশের মানুষ ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে নতুন করে শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। সেক্ষেত্রে মার্কিন দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্রের এ নাগরিককে নিয়ে কি তার দায় এড়াতে পারে?
তিন.
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। বিশ্বের যেকোনো দেশে জনগণের এ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুব্যবস্থা এবং নির্বাচন পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থাকে, এসব প্রতিষ্ঠানই আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ, সুসংহতকরণ ও শক্তিশালীকরণের বিকল্প নেই। বিশ্বের যেসব দেশে গণতন্ত্র সুসংহত হয়েছে, সেসব দেশেই নির্বাচন পরিচালনার প্রতিষ্ঠান বা কমিশন আইনি পরিকাঠামোর দ্বারাই সুসংহত হয়েছে এবং যেসব দেশে গণতন্ত্র সুসংহত হয়নি, সেসব দেশেও নির্বাচন পরিচালনার প্রতিষ্ঠান বা কমিশন আইনি পরিকাঠামোর মধ্যেই থেকে নির্বাচন পরিচালনা করে।
রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা আস্থা ও সহিষ্ণুতার অভাব ক্রমশও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের গণতন্ত্রের বিকাশ ও নির্বাচন ব্যবস্থা কেমন হবে এ নিয়ে সংলাপ হতে পারে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতে হতে পারে। কিন্তু বিএনপি বরাবরই এ পথে না হেঁটে সবসময়ই উল্টো পথে হেঁটেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বেগম খালেদা জিয়াকে জননেত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আমন্ত্রণ জানালে, তা তিনি দাম্ভিকভাবে প্রত্যাখান করেন। এর পরপরই বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা নির্বাচন বানচালের জন্য সারাদেশে সহিংসতা ও অগ্নিসন্ত্রাস ছড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া বিএনপি-জামায়াত দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আলাপ-আলোপচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে না হেঁটে বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে এবং এ ষড়যন্ত্র এখন পর্যন্ত অব্যাহত রাখছে। এখন আবার ২৮ অক্টোবর বিএনপির সহিংসতা এদেশের গণতান্ত্রিক পথকে বাধাগ্রস্ত করতে সহিংসতার পথে হাঁটছে, হরতাল দিচ্ছে, অবরোধ দিচ্ছে যা গণতান্ত্রিক মূলবোধ, সমঝোতা, সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার পথকে আরো রুদ্ধ করছে।
তাছাড়া বর্তমানে এদেশের মানুষ হরতাল চায় না। হরতাল ‘সফল’ করাতে হলে অনেক ঘটনা ঘটাতে হয়। এটা বিএনপির জন্য শুভ হবে না। বাস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, জননিরাপত্তা ব্যাহত করা, জনগণের জান-মালের হানি করা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলাÑ এসব কী ধরনের রাজনীতি। এদেশের শান্তিপূর্ণ রাজনীতির অধিকার সবার আছে। কিন্তু রাজনীতির নামে হামলা, হরতাল, বাস পোড়ানো, জনগণের জান-মালের ক্ষতি এসব কোনো রাজনীতি হতে পারে না।
চার.
বিএনপির নেতৃত্ব শূন্যতা দেশের রাজনীতিকে আরো বেশি অস্থির করে তুলছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে দল চালাচ্ছেন। বেগম জিয়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্ত ও অসুস্থ এবং বিএনপির হাল ধরতে অক্ষম। আগামীতে বিএনপির কে প্রধানমন্ত্রী হবে তাও অমীমাংসিত। তারেক রহমানের ইশারায় বিএনপি চলছে; তার একক সিদ্ধান্তে নিজের স্বার্থের জন্যে বিএনপিকে ব্যবহার করছে। বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারলে তারেক রহমান দেশে আসতে পারবে না। তাই তারেক রহমান তার ব্যক্তিগত স্বার্থে বিএনপিকে সহিংস করেছে, বিদেশে বসে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে। তাই বিএনপি গণতান্ত্রিক পথে হাঁটছে না, নির্বাচনমুখী হচ্ছে না এবং সংবিধানকে তোয়াক্কা করছে না।
বিএনপিকে নিয়ে তারেক রহমানের ভাবনা তার ব্যক্তিগত স্বার্থের বলয়ে বন্দি। বিএনপিকে যদি ক্ষমতায় আনা না যায়, তবে তারেক রহমানের প্রধানমন্ত্রী হবার খায়েশ পূর্ণ হবে না, দেশে আসতে পারবে না। এজন্য ষড়যন্ত্র করে হোক কিংবা অসাংাবিধানিক পন্থায় হোক আ. লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে হবে। কিন্তু বিএনপির একটি গ্রুপ নির্বাচনে যেতে চায়, একটি গ্রুপ আলাপ-আলোচনার পথে হাঁটতে চায়। আবার একটা গ্রুপ তারেক রহমানের নেতৃত্বে সহিংস পথে হাঁটছে। বিএনপির যেসব নেতৃবৃন্দ নির্বাচনমুখী তাদেরকে তারেক রহমান কোণঠাসা করে রাখছে। আর বিএনপির সহিংস গ্রুপটিকে দিয়ে হত্যা, হামলা, জ¦ালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাস, অরাজকতা, সহিংসতাসহ নানা অপকর্ম ঘটাচ্ছেন। কাজেই বোঝা যাচ্ছেÑ শুধু তারেক রহমানের ব্যক্তিগত স্বার্থে বিএনপিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিএনপির এ ভ্রষ্ট নীতির কারণে দলটি চোরাবারিতে আটকে গেছে। এ চোরাবালি থেকে বিএনপির উত্তরণ ঘটবে কিনা সন্দেহ আছে!
পাঁচ.
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কোনো সহিংসতা থাকতে পারে না, জননিরাপত্তা ব্যাহত করার অপকর্ম থাকতে পারে না। বিশ্বে গণতন্ত্র এখন সহযোগিতামূলক গণতন্ত্র (কোলাবরেটিভ ডেমোক্রেসি) পর্যায়ে এসেছে, ভালো কাজে সহযোগিতা, গঠনমূলক সমালোচনা, সহনশীলতা, সংলাপ এগুলো বিদ্যমান। কিন্তু বিএনপি গণতন্ত্রের নামে অরাজকতা করে কী হাসিল করতে চায়, এদেশের মানুষ বিএনপির এ অরাজকতা বরদাস্ত করবে না।
আওয়ামী লীগ সবসময়ই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান ও উদার মনোভাবাসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখালেও বিএনপির অপরাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসছে না। আবারও তারা সহিংস হয়ে উঠছে, অগণতান্ত্রিক পথে হাঁটছে। সংবিধানের প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখাচ্ছে না, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সাংাবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা রাখছে না।
সর্বশেষে, দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে বিএনপি যে অসাংবিধানিক আচরণ করছে এ পথ পরিহার করতে হবে, আলাপ-আলোচনার টেবিলে বসে সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। আগামী দ্বাদশ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে হলে সংবিধান প্রদর্শিত পথে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলগুলোকে হাঁটতে হবে। কাজেই দেশের মানুষের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্যÑ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনমুখী হতে হবে, নির্বাচন কমিশনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য অনড় অবস্থানে থাকতে হবে। আর তাতেই দেশের মঙ্গল হবে, কল্যাণ হবে সাধারণ মানুষের। কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীদের এ শুভবুদ্ধির উদয় না হলে ভ্রষ্ট রাজনীতির চোরাবালিতে আটকে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : আ. লীগ নেতা ও চেয়ারম্যান, শেরে বাংলা ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন