আন্দোলনে জনসমর্থনের ধারাবাহিক ঘাটতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপিকে আবারও সহিংসতার সেই পুরানো কৌশলের পথে নিয়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জ্বালাও-পোড়াও তথা অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে জনগণকে জিম্মি করে তাদের দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার চেষ্টা করছে দলটি।
কিন্তু তাদের এই কৌশল অতীতে তথা ২০১৩-১৫ সালে যেমন কাজ করেনি; এবারও তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে নজিরবিহীন উন্নয়ন।
গত অক্টোবর মাস থেকেই আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে দলটির নেতাকর্মীরা। হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে আচমকা বাসে-ট্রাকে আগুন দিচ্ছে। এভাবে গত এক মাসে অসংখ্য গাড়ি পুড়িয়েছে তারা। এখানে-ওখানে চালিয়েছে ভাঙচুর।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দলটি এই জ্বালাও-পোড়াও তথা আগুন-সন্ত্রাস চালাতে কর্মীদের নগদ অর্থ দিচ্ছে। এমনকি গাড়িতে আগুন লাগাতে মানুষ ভাড়াও করছে। শুধু তাই নয়, বাস-ট্রাকে আগুন দিতে বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
আগুন-সন্ত্রাসে উসকানি
বিএনপির আগুন-সন্ত্রাস চলছেই। এতে দলটির শীর্ষ নেতাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে- গণমাধ্যমে এমন খবর বেরিয়ে এসেছে। এখানেই শেষ নয়, দলটির মিডিয়া সেল থেকেও চলমান জ্বালাও-পোড়াওয়ে উসকানি দেয়া হচ্ছে। এমনকি যারা এমন জঘন্য ও ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাচ্ছে, সেই অগ্নিসংযোগকারীদের নিন্দার বদলে প্রশংসাও করা হচ্ছে।
বিএনপির মিডিয়া সেল এরই মধ্যে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেজে বেশ কিছু ভিডিও ও ছবি পোস্ট করেছে। যেসব ভিডিও ও ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করে সরকারবিরোধী স্লোগান দিচ্ছে দলটির নেতাকর্মীরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ভিডিও ও ছবি প্রচার করে আগুন-সন্ত্রাস ও অগ্নিসংযোগকারীদের আরও উসকে দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে যার সত্যতাও মিলেছে। বিএনপির মিডিয়া সেলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে বেশকিছু ছবি পোস্ট করা হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি মিছিলে হামলাকারীরা মশাল বহন করছে যাতে এসব মশাল জ্বালাও-পোড়াও চালাতে ব্যবহার করা যায়। যা সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
এই ধরনের মশাল মিছিল দেখা গেছে নড়াইল, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, গাজীপুর ও কুষ্টিয়াতে। যা বিএনপির মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়েছে।
গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে এরই মধ্যে উঠে এসেছে, বিএনপির নেতারাই আগুন দেয়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অগ্নিসংযোগকারীকে বাসে আগুন দেয়া বা ভাঙচুরের ভিডিও ধারণ করে তা টাকার বিনিময়ে বিএনপি নেতাদের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রকাশ করা ভিডিও ও ছবিতে যেসব মিছিল দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রায়ই হাতেগোনা কিছু সমর্থকের উপস্থিতি দেখা গেছে। যা প্রমাণ করে, দলটির সহিংস কর্মকাণ্ডে জনসমর্থনের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
যানবাহন পোড়াতে ভাড়া করা হচ্ছে মানুষ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, গাড়িতে আগুন দেয়ার জন্য অটোরিকশা ও রাইডশেয়ারিং করে এমন মোটরসাইকেল চালকদের ভাড়া করছে বিএনপি। এমন জঘন্য কাজের জন্য মাথাপিছু ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি) জানিয়েছে, বিএনপি দেশজুড়ে যে হরতাল ও অবরোধ পালন করছে, তাতে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে দল থেকে কর্মীদের নগদ অর্থ দেয়া হয়েছে।
তত্তাবধায়ক সরকারের দাবিতে গত কয়েক মাস ধরেই নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে আসছে বিএনপি। কিন্তু এসব কর্মসূচিতে তেমন জনসম্পৃক্ততা ও জনসমর্থন দেখা যায়নি। সে কারণেই দলটির নেতাকর্মীরা সেই পুরানো কৌশলেই ফেরে গেছে। বেছে নিয়েছে অগ্নিসন্ত্রাস।
সিটিটিসি প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেছেন, অবরোধকালে অর্থ ও রাজনৈতিক পদ-পদবির প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলীয় কর্মীদের জ্বালাও-পোড়াওয়ে উৎসাহিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কর্মীদের মামলা-মোকদ্দমাকে ভয় না পেতে বলা হয়েছে। কারণ নেতারা ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
সিটিটিসি প্রধান জানান, ‘‘অবরোধের প্রথম পর্যায়ে প্রত্যেক কর্মী গাড়িতে আগুন দেয়ার জন্য ৩ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। দ্বিতীয় পর্বে ‘পুরস্কার' দ্বিগুণ করা হয়েছে।’’
সহিংসতার ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশে চাপ
বেশ কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন, গাড়ি পোড়ানোর ভিডিও গণমাধ্যমে প্রচার করার জন্য বিএনপি নেতারা তাদেরকে চাপ দিচ্ছেন। চলতি বছরের শুরুতে এক সিনিয়র সাংবাদিক এক টকশোতে জানান, বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা অতীতেও গাড়ি পোড়ানোর ভিডিও গণমাধ্যমে সম্প্রচার করতে সাংবাদিকদের প্ররোচিত করেছে।
২০১৩-১৪ সালে দেশজুড়ে আগুন সন্ত্রাস চালায় বিএনপি। সেই সময় শত শত গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। যার ফলে হতাহত হয় বহু মানুষ। সেই সময় বিএনপি-জামায়াতপন্থি অগ্নিসংযোগকারীরা কিভাবে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন সন্ত্রাস চালাত এবং তার ভিডিও ও ছবি গণমাধ্যমে প্রচারে পিড়াপিড়ি করত, সম্প্রতি এক টকশোতে সে কথাই তুলে ধরেন দৈনিক সময়ের আলোর নির্বাহী সম্পাদক হারুন উর রশিদ।
জ্বালাও-পোড়াওয়ে মানসিক ট্রমা
দেশব্যাপী বিএনপি ও জামায়াতের ডাকা দিনের পর দিন অবরোধে সড়কে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তাতে রাজধানীবাসীর মধ্যে রাস্তায় চলাফেরায় আতঙ্ক বেড়েছে; ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। চিকিৎসকরা বলছেন, সারাক্ষণ কেউ শঙ্কায় থাকলে পরবর্তীকালে মানসিক ট্রমা হতে পারে।
অবরোধ উপেক্ষা করে ঢাকাবাসীকে জীবিকার তাগিদে ছুটতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। চড়তে হচ্ছে পাবলিক বাসে। তবে যানবাহনে অবরোধকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়ায় স্বাভাবিক চলাচলে ভীতি কাজ করছে। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের সুস্থভাবে বাড়ি ফেরা নিয়েও দুশ্চিন্তায় থাকেন।
সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতের অবরোধে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাসে আগুন দেয় নাশকতাকারীরা। ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন থেকে ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সারা দেশে ১১০টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর ২৯টি, ২৯ অক্টোবর ১৯টি, ৩০ অক্টোবর ১টি, ৩১ অক্টোবর ১১টি, ১ নভেম্বর ১৪টি, ২ নভেম্বর ৭টি, ৪ নভেম্বর ৬টি, ৫ নভেম্বর ১৩টি এবং ৬ নভেম্বর ১০টি বাস পুড়িয়ে দেয়া হয়।
আগুনের এমন দৃশ্য দেখে জীবন-শঙ্কায় আছেন স্থানীয়রা। শুধু তা-ই নয়, মহানগরীর চলাচলের অন্যতম মাধ্যম রিকশা। জীবিকার তাগিদে ছুটতে হয় রাস্তায় রিকশা চালকদের। অবরোধে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করতে হয় তাদেরও।
সময় সংবাদকে এক গৃহিণী বলেন, ‘নানা প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ চলাফেরা করছে। বাসে আগুন দেয়ার ঘটনায় সবসময় একটা দুশ্চিন্তা কাজ করে। স্বামী কর্মক্ষেত্রে যায়, বাচ্চারা স্কুলে যায়। তারা নিরাপদে পৌঁছাতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে সবসময় আতঙ্ক কাজ করে।’
জাতীয় মানসিক হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ বলেন, হরতাল-অবরোধে বিভিন্ন বাসে আগুন লাগানো হচ্ছে। কারও সামনে যখন একজন লোক আগুনে পুড়ে মারা যায়, সেটা যে দেখবে, তার ভেতর একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। এতে ঘুমের সমস্যা ও মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। এ থেকে পরবর্তীকালে পিটিএসডি বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে।
টার্গেট করা হচ্ছে সাংবাদিকদের
আগুন-সন্ত্রাসের পাশাপাশি সংবাদিকদের প্রতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সহিংস হয়ে উঠেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশকালে সাংবাদিকদের ওপর নজিরবিহীন হামলা চালানো হয়।
ওইদিন বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক গুরুতর আহত হন। বিএনপির এই ধরনের হামলার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সংবাদিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে দলটির নেতাদের সমালোচনা ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত রাখা।
বিএনপির নেতাকর্মীরা নিয়মিতই গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকিও দিচ্ছে তারা। যেমন গত ১১ অক্টোবর দলটির মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজে গণমাধ্যমকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ‘কোন কোন গণমাধ্যম গণতন্ত্রের পক্ষে আর কারা স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে, তা আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’
দলটির এই হুমকিই দুই সপ্তাহ পর ২৮ অক্টোবর ঢাকায় শান্তি সমাবেশের নামে সহিংসতার সময় দেখা যায়। দলটির নেতাকর্মীরা সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত সাংবাদিকদের টার্গেট করে। কোনো রকম উসকানি ছাড়াই হামলা চালায়। সেদিন তারা পিটিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। তাদের হামলায় অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক গুরুতর আহত হন। এর মধ্যে একজন সাংবাদিক পরে মারা যান।