মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫ ৯ বৈশাখ ১৪৩২
মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫
লৌহ কপাট কে ভাঙল
পবিত্র সরকার
প্রকাশ: বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৩, ৪:০৭ PM
সম্প্রতি মুম্বাইয়ে তৈরি ‘পিপ্পা’ বলে একটি ছবিতে নজরুলের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি ব্যবহার করা হয়েছে, খ্যাতনামা সংগীত পরিচালক এ আর রহমানের সুরে, অবশ্যই ভিন্ন একটি সুরে। তাই নিয়ে সমাজমাধ্যমে তর্ক উত্তাল হয়ে উঠেছে, উভয় বাংলা থেকেই। স্বভাবতই মানুষ এ বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। এ লেখক ব্যক্তিগতভাবে ছবিটি দেখেনি, শুনেছি এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একটি ছবি। অবশ্য মুখবই (ফেসবুক) আর হোয়াটস্যাপের বন্ধুদের কল্যাণে সুরটি শুনেছি। সুরটি আহামরি মনে হয়নি। ছবিতে এর ব্যবহারে তার এমন একটা দারুণ সংগতি হয়েছে, যার ফলে মূলের অসাধারণ উদ্দীপনামূলক সুরটিকে বর্জন করার একটা যুক্তি খাড়া করা যায়, এমন কথা এখনো কেউ বলেননি। ফলে আমরা প্রথম প্রতিক্রিয়ায় এ চেষ্টার নিন্দা করেছি, পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের পক্ষে, অন্য অনেকে যেমন করেছেন। আমরা মনে করেছি, ওই কাজটিতে নজরুলের অসামান্য গানটির, তার কথা আর সুরের সম্মিলিত নির্মাণ আর বলিষ্ঠ উচ্চারণের এক ধরনের অসম্মান করা হয়েছে।

তাতে, মুখবই ইত্যাদিতে যেমন হয়, দু-ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। একটা তো আমাদের পক্ষে, সেটাই ব্যাপকতর। সেটা স্বাভাবিক ধরে নিয়ে আমরা বলব যে, এ প্রতিবাদের বিপক্ষেও প্রচুর পোস্ট আমরা দেখতে পাচ্ছি। এতে আমরা একটু অবাক হয়েছি, কারণ নিজেরা, আমাদের অহং-এর দুর্বলতাবশত, একটা ঠিক কাজ করেছি বলে আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু দেখতে পেলাম, আমাদের এ বিশ্বাসটাকে প্রশ্ন করার প্রচুর পক্ষ তৈরি আছে। তাদের মধ্যে যারা আমাদের বিজ্ঞপ্তির মুদ্রণপ্রমাদ ধরেছেন, তাদের কথা ছেড়ে দিয়ে অন্য পক্ষদের কথা বলি। বলা বাহুল্য, তাদের কথারও প্রতিবাদ ও প্রশ্ন করার মানুষের অভাব হচ্ছে না। ফলে আমাদেরও একটু ইতিবাচক উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে, তা থেকেই এই লেখা।

যারা আমাদের এ ঘটনাটির সমালোচনার বিরুদ্ধে, তারা সবাই অবিশেষজ্ঞ বা যোগ্যতাহীন নন। নানা বিষয়ে তাদের অনেকের মতামতের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা পোষণ করি। তাদের মধ্যে নানা দল আছে, আবার দলের মিশনও আছে। কিন্তু মত বা অমতগুলোকে আমরা কয়টি ভাগে ভাগ করে দেখি। প্রথম দল ও তাদের যুক্তি : রহমান ‘মুসলমান’ বলে কোনো এক ‘ইসলামোফোবিয়া’ থেকে আমরা তাকে আক্রমণ করছি। নজরুলকে অবশ্যই আমরা ‘মুসলমান’ বলে সেভাবে গণ্য করি না, কিন্তু তা সত্ত্বেও এ যুক্তি আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। তাহলে তাদের দেখানো উচিত ছিল যে স্রষ্টা মুসলমান হলেই আমরা এ ধরনের আক্রমণ করে থাকি। আমাদের ইতিহাসে এ ধরনের কোনো ধারাবাহিক দৃষ্টান্ত তারা দেখাতে পারবেন বলে মনে হয় না। আর, আমাদের সমালোচনা রহমানের বিরুদ্ধেও নয়। রহমানকে দিয়ে যারা এ কাজ করিয়েছেন তারাও দায়ী, তাতে নজরুলের বংশধরদের দায়ও হয়তো একটু থেকে যায়। কারণ, তাদের এ শর্ত করা উচিত ছিল যে, নজরুলের সুর তারা কোনোক্রমেই বদলাতে পারবেন না। বলা দরকার, আমাদের ‘ইসলামোফোবিয়ার’ ইঙ্গিত কোনো মুসলমান বন্ধু বা তাদের প্রতিষ্ঠান করেননি।

দ্বিতীয় দল ও তাদের যুক্তি : (সুরের কথায় এসে পড়ল) এটা যে নজরুলের সুর তার প্রমাণ কী? হ্যাঁ, এ কথা ঠিকই যে, রবীন্দ্রসংগীতের যেমন একটা ভালোরকমের প্রামাণিক স্বরলিপি-দস্তাবেজ তৈরি হয়েছে, নজরুলের ক্ষেত্রে তা হয়নি। নজরুলের বেশকিছু গানে অন্যদের সুর আছে, তা নথিবদ্ধ। কিন্তু এ গানটি নিয়ে এ পর্যন্ত বিশেষ বিতর্ক ওঠেনি। তবু কেউ কেউ এ প্রশ্ন তুলেছেন। নজরুল গবেষকরাও অবশ্য গানটির রচনার উপলক্ষ্য (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জেলবাস, বাসন্তী দেবীর অনুরোধ, মুজফ্ফর আহমেদের সাক্ষ্য ইত্যাদি) উদ্ধার করে দেখিয়েছেন যে, সব রকম সাক্ষ্যই বলে মূল সুরটা, অন্তত এ গানটির ক্ষেত্রে নজরুলের। আমাদের মতে, সুরের অন্তত অন্তর্গত সংগঠন আর বিদ্রোহের ঝাঁজও সেই সাক্ষ্য দেয়, যা নজরুলের ব্যক্তিত্বের একটা দিকের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। এ সাক্ষ্যগুলোকেও যদি তারা অস্বীকার করেন, তাহলে তাদের বলতে হবে সুরটি অন্য কে দিয়েছিলেন। তা তারা বলতে পারেন না। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, ধরে নেওয়ার কোনো কারণ না থাকা সত্ত্বেও, যে সুরটি নজরুলের করা নয়, তাহলেও আমাদের যুক্তি হলো, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকে বাঙালির ইতিহাস আর সংস্কৃতি এ সুরটিকে নজরুলের বলেই গ্রহণ আর ব্যবহার করে এসেছে, তারও একটা বৈধতা আছে। তাকে অসম্মান করার অধিকার কারও নেই।

তৃতীয় দল ও তাদের যুক্তি : বন্দেমাতরম্ নিয়ে বা রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে যখন এ স্বাধীনতা নেওয়া হয়, তখন আমরা প্রতিবাদ করি না কেন? এতে আমাদের নানা রকমের প্রশ্ন জাগে। প্রথমত, প্রতিবাদ করি না, বা করিনি, এটা তারা কীভাবে জানলেন? শুধু কি ফেসবুকই প্রতিবাদের জায়গা? আর দ্বিতীয়ত, এগুলো কি আদৌ তুলনীয়? বন্দেমাতরমের সুর বঙ্কিমচন্দ্র কী দিয়েছিলেন তা টিকে নেই, রবীন্দ্রনাথের দেশ রাগের সুরটি আমরা প্রায়ই শুনি। কিন্তু একটা গানে যদি রচয়িতা নিজে সুর না দিয়ে থাকেন বা তার সেই সুর বেঁচে না থাকে, তাতে অন্যরা সুর দিতে পারেন-এটা আমাদের কেন, পৃথিবীর নানা সংস্কৃতিই স্বীকার করে নিয়েছে। দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায় গবেষণা করে দেখিয়েছেন, বন্দেমাতরমের সম্ভবত ১০৫টির মতো সুর তৈরি হয়েছে। সেগুলোর গুণাগুণ বা অন্য মহিমা অনুযায়ী জনপ্রিয় হয়েছে বা আড়ালে চলে গেছে। কেউ কেউ বলেছেন, রহমান ‘বন্দেমাতরম’ নিয়েও ছেলেখেলা করেছেন। আমরা তা মনে করি না। তার ‘মা তুঝে সেলাম’ শীর্ষক চমৎকার গানটিতে তিনি ‘বন্দেমাতরম’ কথাটিকে ব্যবহার করেছেন মাত্র, আর কিছু নয়। যেমন করেছেন রবীন্দ্রনাথ তার ‘একসূত্রে বাঁধিয়াছি’ গানে, বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ‘জাগৃতি’ নামে হিন্দি ছবিতে, ‘আও বচ্চেঁ তুমে দিখাও ঘাঁটি হিন্দুস্তানকী’ গানে।

রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে নানা বিতর্কের বিষয়ে আমরা নানা জায়গায় লিখেছি। সেখানও দেখব যে, সভা-সমিতিতে অভিকরণে যত স্বাধীনতা নেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক কম হয় সিডি-ক্যাসেটে। সেটা যখন হয়েছে, তখন জনমত তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এটাই সচরাচর দেখা গেছে।

অন্যদের বেলায় ‘প্রতিবাদ হয়নি’ (ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য) বলে নতুন প্রতিবাদযোগ্য ঘটনাতেও চুপ করে থাকতে হবে, এই যুক্তির অর্থ আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কে কখন প্রতিবাদযোগ্য ঘটনায় প্রতিবাদ করবে তার কি কোনো সংবিধান রচিত হয়েছে? এটা কি একটা ‘প্রিসিডেন্স’ তৈরি করার ব্যাপারÑ যেমন আজকাল দেখানো হয় যে, ‘ওরাও চুরি করেছিল, কম কম করে হলেও তাই আমরা আজকাল আরও বেশি বেশি করে চুরি করছি!’

চতুর্থ একটা দলের যুক্তি হলো, শিল্পের প্রয়োজনে স্বাধীনতা নেওয়া হয়নি তো? আমাদের প্রশ্ন, শিল্পের প্রয়োজনটা কী? হ্যাঁ, সত্যজিৎ তার ফিল্মে রবীন্দ্রসংগীতের অসাধারণ ব্যবহারের পাশাপাশি ‘চারুলতা’য় যেমন ‘চিনি গো চিনি তোমারে’তে কিশোর কুমারকে দিয়ে হারমোনাইজেশন করিয়েছেন সৌমিত্রের গলায়। সেটাকে ওই চরিত্রের উচ্ছ্বাস প্রকাশের একটা সংগত প্রকাশ বলাই যায়, তাকে আমাদের অস্বাভাবিক মনে হয়নি। আমাদের সঙ্গে অনেকের মত নাও মিলতে পারে; কিন্তু ‘পিপ্পা’র ক্ষেত্রে ভিন্ন সুরের ব্যবহারে শিল্পের কোনো উৎকর্ষ ঘটেছে কি? আমি দেখিনি বলে এ প্রশ্ন করছি, যারা দেখেছেন তাদের কাছে। যদি তারা বলেন, হ্যাঁ, গান আর ছবি দুয়েরই দারুণ উৎকর্ষ ঘটেছে, তাহলে আমরা প্রতিবাদ প্রত্যাহারের কথা ভাবতেই পারি।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত