রোকেয়ার জীবন ট্রাজেডিতে ভরপুর। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন অবহেলিত, চিরদুখিনী। তাঁর জীবন ছিল স্রোতের প্রতিকূলে। তাঁর জন্ম জমিদার পরিবারে, কিন্তু সুখ স্বাচ্ছন্দ তাঁকে স্পর্শ করেনি। তাঁর পিতা জহিরুদ্দিন মুহম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন নারী শিক্ষার ঘোর বিরোধী। তিনি তাঁর দুই পুত্র ইব্রাহিম ও খলিলকে কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। কিন্তু কোনো মেয়েকে শিক্ষার সুযোগ দেননি। শুধু বাড়িতে কুরআন শিক্ষার সুযোগ দিয়েছেন। তার পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু। পিতা রোকেয়াকে শিক্ষার সুযোগ না দিলেও তিনি দমবার পাত্রী ছিলেন না। তিনি বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের নিকট গভীর রাতে লেখাপড়া শিখেছেন। তাঁর বাবা-মা যখন ঘুমিয়ে পড়তেন, তখন মোমবাতি জ্বালিয়ে তিনি ভাইয়ের কাছে পড়তে যেতেন। পিতার অজান্তে তিনি ভাইয়ের কাছে বাংলা, ইংরেজি শিখেছেন। কেননা পিতা জানলে তাঁর খবর ছিল! নিজস্ব প্রচেষ্টায় তিনি স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত হন।
রোকেয়ার সময়ে মেয়েদের যে বয়সে বিয়ে হয় তার চেয়ে অনেক দেরিতে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর পিতা নাক ছিটকাতে ছিটকাতে মেয়েকে আর বিয়ে দিতে পারছিলেন না। এ দিকে পিতা অর্থাভাবে পর্যদস্তু হয়ে গেছেন। শেষে পিতার বয়সী রোগাক্রান্ত বিপত্নীক বিহারের ভাগলপুরের জমিদার নন্দন সাখাওয়াত (১৮৫৫-১৯০৯) নামে এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে রোকেয়ার বিয়ে হয়, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ। এ বিয়ে শুধু বিয়ের জন্য বিয়ে। এ ঘরে রোকেয়ার দুইটি মেয়ে হয়, তা ৪-৫ মাস বয়সে মারা যায়। স্বামী সাখাওয়াত ছিলেন ডায়াবেটিকসহ নানা রোগে জর্জড়িত। সাখাওয়াত হোসেন ১৯০৮ সালের ১৩ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য সরকারের নিকট থেকে দেড় বছরের জন্য ছুটি নেন। ছুটি শেষ হওয়ার আগে তিনি ১৯০৯ সালের ৩ মে চূড়ান্ত ছুটি নেন অর্থাৎ মারা যান। রোকেয়ার দাম্পত্য জীবন ছিল রোগী ও সেবিকার সম্পর্কের ন্যায়। মোহসেনা রহমান (মোনা)কে লিখিত ৩০ এপ্রিল, ১৯৩১ তারিখের এক চিঠিতে রোকেয়ার দাম্পত্য জীবনের করুণ দৃশ্য ফুটে উঠে। তিনি লিখেছেন, ‘শৈশবে বাপের আদর পাই নি, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। প্রত্যেহ ইউরিন (প্রসাব) পরীক্ষা করেছি। পথ্য রেঁধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি। দুবার মা হয়েছিলুমÑ তাদেরকে প্রাণভরে কোলে নিতে পারিনি। একজন ৫ মাস বয়সে, অপরটি ৪ মাস বয়সে চলে গেছে। আর এই ২২ বছর যাবত বৈধব্যের আগুনে পুড়ছি।’ (মোস্তফা মীর সম্পাদিত রোকেয়া রচনাবলী, পৃ. ৪৭৫।)
স্বামীর মৃত্যুর ৫ মাস পরে ভাগলপুরে ৫ ছাত্রী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। স্বামীর প্রথমপক্ষের কন্যা ও জামাই তাঁর উপর অত্যাচার করতে শুরু করেন। তারা চান তিনি সেখান থেকে সরে পড়ুন। কেননা তিনি বিষয়-সম্পত্তির ভাগ চাইতে পারেন। তাদের অত্যাচারে তিনি ভাগলপুর ছাড়তে বাধ্য হন এবং কোলকাতায় আশ্রয় নেন ১৯১০ সালে। ১৯১১ সালে তিনি কোলকাতার অলিউল্লাহ লেনে ৮ জন ছাত্রী নিয়ে নতুন করে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল শুরু করেন। তিনি স্বামীর কাছে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা করলে তিনি তাঁকে ১০,০০০ (দশ হাজার) রুপি দেন। এ টাকাটা রোকেয়া কোলকাতার বার্মা ব্যাংকে রাখেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ব্যাংকটি দেউলিয়া ঘোষিত হলে তাঁর টাকাটাও খোয়া যায় নভেম্বর ১৯১১। তাঁর স্কুলের ২০,৫০০ (বিশ হাজার পাঁচশত) রুপি রাখা হয় ফরিদপুর সমবায় ব্যাংকে। সে টাকাও নাকি ব্যাংক দেউলিয়ার কারণে খোয়া যায়। রোকেয়া এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘স্কুলের একটা বাড়ি হল না, হেড মিস্ট্রেসের ঠিক নেই। এই দুটি সমস্যার ওপরে আবার ফরিদপুর ব্যাংক সম্বন্ধে নানা সাংঘাতিক গুজব শুনতে পাচ্ছি। ওখানে আমাদের ২০৫০০ টাকা রয়েছে। আমার মতো এক গরিব মেয়েলোককে মেরে ফেলবার জন্য এই কি যথেষ্ট নয়?”(মোস্তফা মীর সম্পাদিত রোকেয়া রচনাবলী, পৃ. ৪৭৬।)
নারীশিক্ষার প্রসার ঘটাতে গিয়ে তাঁকে অনেক কিছু হজম করতে হয় এবং অনেক কিছুর সাথে আপোস করতে হয়। তিনি পর্দা প্রথায় বিশ্বাসী নন। তারপরেও তিনি বোরকা পরতেন। কেননা, তা নইলে তাঁর স্কুলে মুসলমানরা তাদের মেয়েদের পড়তে দিবেন না। তিনি পর্দা পরিধান করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুসলিম অভিভাবকদের বুঝিয়ে তাদের মেয়েটিকে তাঁর স্কুলে পাঠানোর অনুরোধ করতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি ১৯১৫ নালে উচ্চ প্রাথমিক, ১৯১৭ সালে নিম্ন মাধ্যমিক এবং ১৯৩০ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯১৭ সালে তিনি তাঁর স্কুলে ছাত্রীর সংখ্যা ৮ থেকে ১০৭ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। এদের মধ্যে ২ জন বাংলাভাষী, বাকি ১০৫ জন ছিল উর্দুভাষী। তাঁর ইচ্ছা ছিল বাংলাভাষী ৪০ জন ছাত্রী পেলে স্কুলে বাংলা সেকশন খুলবেন। তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। মেয়েদের স্কুল খোলার জন্য অনেক ধার্মিক মুসলমান তাঁর উপর অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করতেন, অপবাদ আরোপ করতেন। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় লিখে তার উত্তর দিতেন। তাছাড়া তৎকালীন সমাজ একজন বিধবাকে অমঙ্গলসূচক বিবেচনা করত। তাঁর উপর পর্দা নিয়ে অভিযোগের অন্ত ছিল না। তাঁর ভাগনে করিম গজনবী, হালিম গজনবী বিলাত ফেরত, উচ্চশিক্ষিত, কংগ্রেস, মুসলিম লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতা, ব্যবসায়ী, নাইট, স্যার, নবাব বাহাদুর উপাধিপ্রাপ্ত। করিম গজনভী ১৯২৪ ও ১৯২৭ সালে মন্ত্রী। তাঁর ভাগনে তাঁকে শর্ত দেন, খালা যদি যথোপযুক্ত পর্দা মেনে চলেন, তাহলে তাঁর স্কুলটিকে তিনি সরকারি করে দেবেন। হুমায়ুন আজাদ তাঁর নারী গ্রন্থে এ ঘটনাকে উল্লেখ করেছেন, পুত্র শেখায় মাকে সতিত্বÑ এ হল পিতৃতন্ত্র। ১৯১৬ সালে তিনি নারীদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে ‘আঞ্জুমানে কাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
রোকেয়ার সারা জীবনের যুদ্ধ ছিল নারীকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা, নারী-পুরুষের বিভেদ হ্রাস করা, নারী যেন পুরুষের ন্যায় অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তখন নারী ছিল পুরুষের দাসী। নারীকে মানুষ মনে করা হতো না। এখনো মনে করা হয় না। মানুষ বলতে পুরুষ পুরুষকেই বুঝে। নারীও তাই মনে করে। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে যেমন নারীর সমালোচনা করেছেন তেমনি জাগরণের কথাও বলেছেন। তিনি বলেন, ‘বহুকাল হইতে নারী-হৃদয়ের উচ্চবৃত্তিগুলি অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায়, নারীর অন্তর, বাহির, মস্তিস্ক, হৃদয় সবই দাসী হইয়া পড়িয়াছে। এখন আর আমাদের স্বাধীনতা, ওজস্বিতা বলিয়া কিছু নাইÑ এবং তাহা লাভ করিবার প্রবৃত্তি পর্যন্ত লক্ষিত হয় না। তাই বলিতে চাই, অতএব জাগো, জাগো গো ভগিনি। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব।’ তিনি নারীর অলঙ্কার পরিধানকে দাসত্বের নিদর্শন বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মানুষ হতে চাইলে কী হবে? পুরুষ তাঁকে মানুষ হতে দেবে না। তাই পুরুষ তাঁর নামের পূর্বে বেগম যুক্ত করে পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিল।
রোকেয়া কখনো তাঁর নামের পূর্বে বেগম ব্যবহার করেননি। তাঁর লেখা চিঠিপত্র, প্রবন্ধে, গল্পে, উপন্যাসে বা স্কুলের কর্মকাণ্ডে নামের আগে স্ত্রীবাচক বেগম শব্দটি ব্যবহার করেননি। ঐ সব জায়গায় তিনি লিখেছেন রোকেয়া, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, আরএস হোসেন, (মিসেস) আর এস হোসেন লেখা আছে। বিয়ের পূর্বে তাঁর নাম ছিল রোকেয়া খাতুন। আজ রোকেয়া বলতে বুঝায় বেগম রোকেয়া। ভাগ্যিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ হলের নামকরণে বেগম শব্দটি ব্যবহার করেননি। হলের নাম রেখেছে রোকেয়া হল। এ যুগে হলে এর নাম বেগম রোকেয়া হল নামকরণ করা হত। বেগম হচ্ছে স্ত্রীলিঙ্গের প্রতীক। লিঙ্গের পরিচয়ে তিনি পরিচিত হতে চাননি। পুরুষ তো তার নামের পরিচয় দেওয়ার জন্য পুরুষবাচক কিছু ব্যবহার করে না। তবে নারীর ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করতে হবে কেন? লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেই তাঁর যুদ্ধ। অথচ যার বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ তা-ই তাঁর উপর আরোপ করা কি তাঁকে অসম্মান করা নয়?
রোকেয়া নারী জাগরণের কথা বলেছেন, নারী মুক্তির কথা বলেছেন, নারী শিক্ষার কথা বলেছেন, নারীকে ঘর থেকে বের করে এনে শিক্ষা দিয়েছেন, নারী শিক্ষার জন্য স্কুল খুলেছেন, নারীকে দাসত্ব থেকে বের করে মানুষের পর্যায়ে উন্নীত করতে চেয়েছেনÑ এটাই তাঁর অপরাধ। এ অপরাধের জন্য জীবিতকালে তাঁকে অনেক লাঞ্জনা সইতে হয়েছে, মৃত্যুর পরেও তা থেকে তিনি মুক্তি পাননি। মৃত্যুর পরে ধার্মিক মুসলিম ভাইয়েরা তাঁকে কোলকাতা মুসলিম গোরস্থানে দাফন করতে দেননি। তাঁর সমাধিস্থল হয়ে যায় অজ্ঞাত। অবশেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের দোহিত্রী নাসিমা বানুর অর্ধাঙ্গ অমলেন্দু দে (১৯২৯-২০১৪) তাঁর সমাধি আবিষ্কার করেন। তারপরে জানা যায়, কোলকাতার উপকণ্ঠে, গঙ্গার ধারে, সোদপুরের পানিহাট্টায় আবদুর রহমান নামক এক ব্যক্তির ভূমিতে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল। রোকেয়ার অনুকূল বলতে কিছুই ছিল না। সবই ছিল তাঁর প্রতিকূলে। প্রতিটি প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে তিনি নারী জাগরণের পথ দেখিয়েছেন, নারী মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছেন, সর্বোপরি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। ৯ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু দিবস উপলক্ষ্যে চরণে ভক্তি নিবেদন করি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস, সম্পাদক, এনসিটিবি