আমাদের পথ স্বাধীনতার পথ। যাঁরা সংগ্রাম করে, সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন; গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের আমরা স্মরণ করি। তাঁদের মধ্যে আছেন রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, কৃষক, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত—যাঁদের সাধনা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পার হয়েছে, এর মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশকে আমরা কতটা গড়ে তুলতে পেরেছি? ২০২৩ সালে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রভৃতি শক্তির প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রমুখের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন বাংলাদেশকে তাঁদের শিবিরভুক্ত করার জন্য।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে নিয়ে আমাদের বাংলাদেশকে তাঁরা চীনবিরোধী শিবিরের অন্তর্ভুক্ত করতে চান। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা দৃষ্টান্ত তাঁরা খুঁজে বের করছেন। বাংলাদেশের দুর্বলতাগুলো তাঁরা ভালোভাবে জেনে নিচ্ছেন তাঁদের স্বার্থ হাসিলের প্রয়োজনে সুবিধামতো কাজে লাগানোর জন্য। গত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর বাংলাদেশের একান্ত অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের আরো কিছু বড় দৃষ্টান্ত আছে।
বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে উঠত, তাহলে বাইরের কোনো শক্তি এভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে আসত না। রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ খুব দুর্বল ও খারাপ অবস্থায় আছে।
অর্থনৈতিক উন্নতি কিছুটা হয়েছে। দৃশ্যমান কিছু বড় কাজ করা হয়েছে; যেমন—কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে সুড়ঙ্গপথ, পদ্মা সেতু, ঢাকায় মেট্রো রেল, দেশব্যাপী রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ইত্যাদি। করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু, ইউক্রেনে যুদ্ধ, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের সামরিক আক্রমণ ও গণহত্যা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে আর্থিক সংকট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বাংলাদেশে এবং গোটা পৃথিবীতে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। বিপর্যয় কি বাড়তে থাকবে? বলা যায় না। আমাদের যদি কোনো রাষ্ট্র না থাকে, তাহলে কি আমরা ভালো থাকব? রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার কি কোনো বিকল্প আছে?
তাঁবেদারি নয়, রাজনীতিতে চাই দেশপ্রেমমানুষের আর্থিক উন্নতির সঙ্গে মানসিক উন্নতি হয় না। মানুষের বৈষয়িক উন্নতি হলে, তার সঙ্গে মানসিক উন্নতি আপনাতেই হয় না। প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষের নৈতিক চেতনা নিম্নগামী হয়।
সাধারণ মানুষ জাগ্রত না হলে, উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে না পারলে ধনিক শ্রেণির বাইরে অন্য সব মানুষ শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়। বাংলাদেশের জনজীবনে তা-ই হচ্ছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ও শ্রমশক্তির কল্যাণে উৎপাদন ও সম্পদ যেভাবে বাড়ছে, তাতে আইনকানুনের দ্বারা ন্যায় কিছুটা বাড়ালে দুনিয়াব্যাপী সব মানুষের খেয়ে-পরে চলা ও সম্মানজনক জীবনযাপন সম্ভব হবে। কিন্তু ন্যায় যাঁরা বাড়াতে পারেন, তাঁদের মধ্যে ন্যায় বাড়ানোর কোনো আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা খুঁজে পাওয়া যায় না।
দুনিয়াব্যাপী সাধারণ মানুষ নিস্পৃহ। অত্যুন্নত প্রচারমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে জনসাধারণকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কাজে। তথ্য-প্রযুক্তি ও জীব-প্রযুক্তির বিপ্লব এবং সৌভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির (১৯৯১) পর কোন রাষ্ট্রের, কোন জাতির জীবনে কী ঘটেছে, তা অনুসন্ধান করে দেখলে বোঝা যাবে সভ্যতার গতি কোন দিকে। কোনো অনুসন্ধান না করেই বলতে পারি, কায়েমি স্বার্থবাদীরা ও হীন স্বার্থান্বেষীরা অর্থ-সম্পদের মালিকানা লাভের এবং ক্ষমতা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কাজে আগের মতোই কিংবা আগের চেয়েও বেশি তৎপর। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে অধিকার চেতনা, আত্মমর্যাদাবোধ ও সংগ্রামী স্পৃহা নিষ্প্রভ। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি (১৯৯১) পর্যন্ত সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে জাগরণ ছিল, যা গণজাগরণ বলে অভিহিত হতো, তা আর নেই।
যারা বাংলাদেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়, ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করে, পরাধীন করে মীরজাফরের ভূমিকা পালন করে, তাদের পথ আমাদের পথ নয়। আমরা জানি, প্রতিটি রাষ্ট্রকে আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের মধ্যে বাস করতে হয়। এর জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রকেই প্রয়োজনের ক্ষেত্রে নিজের স্বাধীনতা কিছুটা ত্যাগ করতে হয় এবং অন্যের স্বাধীনতা কিছুটা স্বীকার করতে হয় এবং এভাবে প্রত্যেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হয়। নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সর্বাবস্থায় নিজের কাছে রাখতে হয়।
আত্মনির্ভরতা ও স্বাধীনতার জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনো কিছুর জন্যই স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতা ত্যাগ করা যায় না। বাংলাদেশে রাজনীতি নিয়ে যাঁরা ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীদের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে ছোটাছুটি করেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্য চাইতে ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে গিয়ে ধরনা দেন, তাঁরা আমাদের স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দেন। আমাদের আজকের স্বাধীনতা ১৯৭১-এর স্বাধীনতার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কিংবা কম মূল্যবান নয়।
বাংলাদেশে অন্তত চার দশক ধরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে কাণ্ডকারখানা আমরা দেখে আসছি, তার কোনো শুভকর দিক কি আছে? প্রতিবার যে অর্থ এই নির্বাচনের জন্য ব্যয় করা হয়, তা কি সামান্য? বাংলাদেশে সর্বজনীন কল্যাণে এই অর্থ দিয়ে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। সরকার যদি পক্ষপাত ও হীন স্বার্থপরতা পরিহার করে সর্বজনীন কল্যাণে চিন্তা ও কাজ করে, তাহলে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের জীবনই অনেক সুন্দর ও সুখকর হতে পারে। কিন্তু সে রকম চিন্তা ও কাজ দুর্লভ। কবি শামসুর রাহমানের একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে। গত শতকের ষাটের দশকে রচিত একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন : ‘যাদের কথায় জগৎ আলো/বোবা আজকে তারা, মুখে তুবড়ি ছোটে যাদের/আকাট মূর্খ যারা।’
তারপর অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। মানুষ, মানুষের পরিবেশ ও স্বভাব বদলে গেছে। তা সত্ত্বেও কবির এই কথাগুলোকে আজও ঠিক মনে হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। তাই ডিসেম্বর মাসকে আমরা আমাদের বিজয়ের মাসরূপে উপলব্ধি করি, উদযাপন করি। গত অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ে বাংলাদেশে আমরা কী করেছি, কী করতে পারতাম, এখন আমাদের করণীয় কী? এসব নিয়ে দরকার আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির অনুশীলন।
ছাত্র-তরুণদের মধ্যে যারা মেধাবী ও পরিশ্রমী, তারা বাংলাদেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণে উদগ্রীব। মা-বাবাও তাদের পশ্চিমা কোনো রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব লাভে সহায়তা করেন। এই ধারার লোকেরা মনে করে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ উন্নত হবে না এবং বাংলাদেশে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা থাকবে। এই অবস্থায় ভালো জীবন লাভের জন্য পশ্চিমা কোনো রাষ্ট্রে গিয়ে বসবাস করা এবং নাগরিকত্ব গ্রহণ করা যুক্তিসংগত। যাঁরা মন্ত্রিপরিষদে আছেন; জাতীয় সংসদে আছেন; প্রশাসন ব্যবস্থায় কিংবা রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ে আছেন; তাঁদের প্রায় সবার সন্তান-সন্ততি পশ্চিমা নানা দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে আছে। এই বিদেশমুখিতার কারণ জানা দরকার।
আমরা চাই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে। যাঁরা সরকার গঠন করেন, রাষ্ট্রীয় সব কিছু পরিচালনা করেন, তাঁদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি ও স্বাজাত্যবোধ না থাকলে বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যাবে না এবং আমরা পরিচালিত হব আধিপত্যবাদী বিদেশি শক্তি দ্বারা।
বিজয় দিবসে কেবল বীরপূজায় মগ্ন থাকলে সুফল হবে কিভাবে? ইতিহাসকে পক্ষপাতিত্বমুক্ত, পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে মিথ্যামুক্ত করে ভাবতে ও বিচার করতে হবে। ইতিহাসের দর্শনে কেউ কেউ লিখেছেন, প্রতিটি জেনারেশনকেই তার প্রয়োজনীয় ইতিহাস নতুন করে লিখতে হয়। কথাটির তাৎপর্য বুঝতে হবে। কোনো বিষয়েরই ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া কেবল বর্তমানের জ্ঞান নিয়ে সেই বিষয়ের জ্ঞান পর্যাপ্ত ও কার্যোপযোগী হয় না। ইতিহাস নিয়ে আরো অনেক গুরুতর প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশে ইতিহাসের চর্চা অল্পই আছে। শিক্ষাব্যবস্থায়ও ইতিহাসের জ্ঞানার্জনকে অল্পই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় ইতিহাসকে পরিপূর্ণ গুরুত্বে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে স্থান দিতে হবে। কে বা কারা দেবেন সেই গুরুত্ব? শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কি ঠিকমতো চলছে?
পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন সামনে নিয়ে যে কাণ্ডকারখানা দেখা যায়, তা বাংলাদেশের রাজনীতির চরম নিকৃষ্টতারই পরিচায়ক। রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি জনসাধারণের কোনো শ্রদ্ধাবোধ কি আছে? জনসাধারণ ক্রমেই রাজনীতিবিমুখ হচ্ছে। জনগণের রাজনীতিবিমুখতা দ্বারা রাজনীতির উন্নতি হবে না। রাজনীতিকে উন্নত নতুন চিন্তা ও কাজ দিয়ে উন্নত করতে হবে। ১৯৮০-র দশকে ডিপলিটিসাইজেশন, নিঃরাজনৈতিকীকরণ, বিরাজনৈতিকীকরণ—এই তিনটি কথা খুব উচ্চারিত হতো। ওই সময় থেকে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তাদের সহযোগী পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলো সুপরিকল্পিতভাবে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতিকে অন্তঃসারশূন্য রূপ দেওয়ার জন্য কাজ করে চলছে। গণতন্ত্রকে যে রূপ দিয়েছে, তা হলো নির্বাচনতন্ত্র। সমাজতন্ত্রকে পরিণত করেছে সম্পূর্ণ আবেদনহীন ব্যাপারে। বাস্তবে পৃথিবীর কোথাও এখন কার্যকর কোনো রাজনৈতিক আদর্শ নেই।
বাংলাদেশে সবার কর্তব্য রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করা। বর্তমানে উদার গণতন্ত্রের নামে যেসব কথা প্রচার করা হয় এবং সেই ধারায় যেসব কাজ করা হয়, সেগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়—উদার গণতন্ত্র হচ্ছে ধনিক-বণিকদের ও সাম্রাজ্যবাদের দালালদের গণতন্ত্র। উদার গণতন্ত্র নয়, দরকার সর্বজনীন গণতন্ত্র। সর্বজনীন গণতন্ত্রের রূপ ও প্রকৃতি প্রতিটি জাতির রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের চিন্তার ও মত প্রকাশের মাধ্যমে নির্ধারণ করে নিতে হবে। সর্বজনীন গণতন্ত্রের জন্য প্রতিটি জাতিকে অবলম্বন করতে হবে ‘দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার’। প্রতিটি জাতির ভৌগোলিক বাস্তবতা, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য বিবেচনা করে দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দল গঠনে যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। জাতীয় রাজনীতিতে দলই হবে সরকার গঠনের ও জনজীবন পরিচালনার মূল ভিত্তি।
লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়