"আজকে যখন ট্রেনের ভেতরে মায়ের কোলে শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায়,তখন আমাদের বলতে হয় এই ঘটনা রাজনীতির ফসল হতে পারে না। এটা অন্য কিছু, এই অন্য কিছু স্বাধীন বাংলাদেশে আর দেখতে চাই না। আমাদের এখন নাশকতাকে না বলতে হবে"- গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চলা নাশকতার বিরুদ্ধে এই ভাষায় ক্ষোভ আর আক্ষেপ এসেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে।
বিএনপি ও সমমনাদের রাজনৈতিক আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে, বাস-ট্রেনে আগুনের ঘটনায় প্রাণহানি এবং নানা ধরনের নাশকতার প্রতিবাদে রাজধানীতে প্রতীকী পদযাত্রা করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। পদযাত্রায় মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী, প্রতিবাদী নারী সংগঠন, সচেতন নাগরিক সমাজসহ ৩৯টি পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা অংশ নেন।
রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা শাহবাগ তখন অনেকটাই স্তব্ধ। মাইকে ভেসে আসছে এক যুবকের আর্তনাদের শব্দ। সদ্য স্ত্রী-সন্তান হারানো এই যুবকের বিলাপে যেন থেমে গেছে কোলাহল, যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা বাহনের যাত্রীরাও নিশ্চুপ। মঞ্চের সামনে তার মতোই বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় বিচারের দাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শতশত মানুষ।
ঐ যুবক আর্তনাদ করে বলছেন, ‘আমি জাতির কাছে বিচার দিতে এসেছি। যারা আমার স্ত্রী-সন্তানকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়। আমি স্ত্রী-সন্তান হারিয়েছি। আমাকে লাশ বহন করে নিয়ে যেতে হয়েছে। যারা আগুনে মানুষ পোড়াচ্ছে, তাদের বিচার চাই।‘
কথাগুলো বলছেন বটে, কিন্তু কান্নার দমকে অর্ধেক শব্দ নাই হয়ে যাচ্ছিল। মঞ্চে বা মঞ্চের সামনে যারা ছিলেন, তারাও নিজেদের চোখ মুছছেন মিজানের কথা শুনে।
শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘আমরাই বাংলাদেশ’ ব্যানারে আয়োজিত প্রতিবাদী পদযাত্রায় কথাগুলো বলেন সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় স্ত্রী-সন্তান হারানো মিজানুর রহমান মিজান।
তিনি বলেন, ‘যে সন্তানকে সুন্দর করে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। তাকে আর কোলে নিতে পারি নাই। লাশ কোলে নিয়ে বাড়িতে যেতে হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বিচার দাবি করি। আমি একজন সাধারণ মানুষ খেটে খাওয়া মানুষ। স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে সুন্দরমতো জীবনযাপন করছিলাম। আমার জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। তার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার করবেন। আমার স্ত্রী-সন্তানের কী দোষ ছিল? প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই দাবি, এই অপরাধীদের যেন বিচার হয়। আর কোনও দাবি নেই।’
উল্লেখ্য, গত ১৯ ডিসেম্বর বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা অবরোধের দিন দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে মারা গেছেন নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার শিশু সন্তান ইয়াসিন। মায়ের কোলেই ছিল ৩ বছর বয়সী শিশুটি। বগিতে আগুন লাগলে সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছিলেন মা নাদিরা আক্তার, মরদেহ উদ্ধারের সময়ও শিশুটি তার কোলেই ছিল।
গত কয়েকদিন ধরেই গণমাধ্যমে নানাভাবে মিজানুর রহমান বিচারের দাবি জানিয়েছেন। তিনি আজ অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার আরও অনেকের সঙ্গে নিজের কষ্ট ভাগাভাগি করতে এসেছিলেন। শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মিজানুর রহমান এসেছিলেন অন্য অনেক ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী সন্তানকে হারিয়েছি, তাদের আর ফিরে পাবো না। আমি একজন সাধারণ মানুষ। ছোট চাকরি করে সংসার বাচ্চা নিয়ে চলতাম। এ আগুনে আমার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে যাওয়াতে আমি জীবনকে অনেক পিছে ফেলে এসেছি। এই আগুন বন্ধ করে মানুষের সন্তান, স্ত্রী পোড়ানো বন্ধ করেন। নিজের বিবেককে কাজে লাগান।’
কান্নারত মিজানুর রহমান বলেন, ‘নিজের সন্তান হারালে কী কষ্ট হয়, সেই হুঁশটুকু নিজের ভেতরে তৈরি করুন। তাহলে বুঝতে পারবেন, সন্তান পুড়লে কী কষ্ট হয়। যার হারায় সে বুঝতে পারে। চোখের সামনে আমার স্ত্রী-সন্তান পুড়ে গেছে, আমার যে কী অবস্থা আমি বুঝতেসি। আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আমার স্ত্রী-সন্তানের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’
পদযাত্রায় অংশ নেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল। পদযাত্রা শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তাদের একজন রেদওয়ানুল হক বলেন, ‘এই কষ্ট আমার বাবারও হতে পারে যে কোনোদিন। এই বিচার যেন মিজানুর রহমানকে একা চাইতে না হয়, সেজন্য আমরা সবাই এখানে জড়ো হয়েছি। সবাই প্রতিবাদী হয়ে উঠলে এই বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সাহস করবে না।
বিচারের দাবিতে সংগঠিত হওয়া পদযাত্রার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘উপযুক্ত শাস্তির মধ্য দিয়ে এই অগ্নিসন্ত্রাস বন্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আজ ভুক্তভোগী মিজান বলছেন— সে বিচারের দাবি নিয়ে এসেছে। এই বিচারের দাবি আমাদের সকলের। আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারা কোন রাজনীতি হতে পারে না।’
২০১৩ সালে শাহবাগে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় হাত ঝলসে যাওয়া খাদিজা নাসরীন বলেন, ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর যখন অফিস থেকে শাহবাগ এসে পৌঁছাই, তখন বাসে আগুন দেওয়া হলে সব যাত্রী চিৎকার করছিল। আমার দুটি হাত ঝলসে গেছে। তারপর আমার এই দুই হাতে অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগেছি বেশকিছু দিন।আমরা সেই ২০১৩ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এই অগ্নিসন্ত্রাসের সুপ্রিম হুকুমদাতাকে না বলি। এই অগ্নিসন্ত্রাসের হুকুমদাতাদের বিচার করতে হবে।
‘অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ নারী সমাজ’ ব্যানারে পদযাত্রায় অংশ নিয়ে মারিয়া বেগম বলেন, ২০০৯ সালের পর থেকে দেশ শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়। সেই উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য ২০১৩ সাল থেকে একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করে। আমরা তাদের বিচার দাবি করছি এবং তাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করছি।
পদযাত্রা শেষে শাহবাগে অস্থায়ী মঞ্চে বক্তব্য রাখেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইইনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরীসহ অগ্নিসন্ত্রাসে আহত এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা।
সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও সাংবাদিক সমাজের শীর্ষ নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, দেশের মানুষ ইতিমধ্যেই অগ্নিসন্ত্রাস প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি বলেন, ভোট বর্জন গণতান্ত্রিক অধিকার কিন্তু ভোট বর্জনের নামে অগুন দিয়ে দেশের সম্পদ ধ্বংস, মানুষ পুড়িয়ে মারা অবশ্যই রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। সরকারকে কঠোরহাতে এই অগ্নিসন্ত্রাস দমন করতে হবে।
সভায় বিএফইউজে মহাসচিব দীপ আজাদ, ডিইউজে সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেন, বাংলাদেশ সম্পাদক ফোরামের আহবায়ক রফিকুল ইসলাম রতনসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ বিপুল সংখ্যাক প্রতিবাদী নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন।